মেগা প্রকল্পে সুন্দরবনের মোহনা ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে

ছবি : বণিক বার্তা

নদী ও প্রকৃতি গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। তিন দশকের বেশি সময় ধরে নদ-নদী ও জলাশয় নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা তার। রাজশাহীর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘‌হেরিটেজ রাজশাহী’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের নদ-নদী ও নগরায়ণের গোড়াপত্তন নিয়ে লিখেছেন ২০টিরও বেশি গ্রন্থ। কর্মসূত্রে দীর্ঘ সময় সুন্দরবনকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে দুই বাংলার সুন্দরবন নিয়ে করেছেন গবেষণা সুন্দরবনের নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল ফাতাহ মামুন


কর্মসূত্রে জীবনের বড় একটা সময় সুন্দরবন এলাকায় কাটিয়েছেন তখনকার সুন্দরবন আর এখনকার সুন্দরবনের মধ্যে কী কী পরিবর্তন এসেছে? বিশেষ করে সুন্দরবনের নদী ও প্রাণবৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে চাই

সুন্দরবনের সঙ্গে আমার পরিচয় কিশোর বয়স থেকে আমার বড় ভাই রাজশাহী শহরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন ষাটের দশকের কথা তখন ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি বড় ভাই সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার করে ফিরেছেন প্রথম হরিণের মাংস খেলাম তখন থেকেই সুন্দরবনের প্রতি এক ধরনের টান অনুভব শুরু করলাম এরপর ৬৭ সালে সুন্দরবনের মোংলায় পিকনিক করতে যাই এই প্রথম আমার সুন্দরবন দেখা ৭২ সালে পুলিশে যোগ দিই তখনো খুলনায় পোস্টিং হয়নি ৭৮ থেকে ৮২ পর্যন্ত পাবনায় ছিলাম ওই সময়ে বিচিত্রা কাগজে সুন্দরবনের বাঘশিকারি পচাব্দী গাজীকে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয় ওই প্রতিবেদন আমাকে খুব শিহরিত করল এরপর ৮২ সালে খুলনার শ্যামনগর থানায় অফিসার ইনচার্জ হিসেবে পোস্টিং হয় সুন্দরবন বাংলাদেশ অংশের ৩৫ ভাগই পড়েছে এই শ্যামনগর থানায় এখানেই আমার দীর্ঘ কর্মজীবন কাটে ধীরে ধীরে সুন্দরবনের নদ-নদী ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আগ্রহী হই খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, এ সুন্দরবনে একসময় গণ্ডার ও মহিষ ছিল এ রকম আরো কয়েক প্রজাতির বন্যপ্রাণীর খোঁজ পাই, যেগুলো আগে ছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় ২০০১ সালে সুন্দরবনের আরেকটি থানায় বদলি হই দাকোপ থানায় কর্মজীবনে কাজের বাইরে গবেষণা করা হয়ে ওঠেনি তবে এ দীর্ঘ সময় সুন্দরবন নিয়ে যত বই, গবেষণাপত্র পেয়েছি সব সংগ্রহ করেছি অবসরের পর পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন নিয়ে কাজ শুরু করি একপর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের একজন গবেষকের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যায় বাংলাদেশ ও কলকাতা দুই অংশের সুন্দরবন নিয়েই সমানতালে কাজ শুরু করি কাজ করতে গিয়ে নথিপত্রের দিক থেকে আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে পশ্চিবঙ্গের দুজন লেখকের বইপত্র একজন হলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র তার লেখা যশোর-খুলনার ইতিহাস বই থেকে আমি অনেক উপকৃত হয়েছি আরেকজন হলেন পশ্চিমবঙ্গেরই লেখক এএফএম আব্দুল জলীল তার লেখা সুন্দরবনের ইতিহাস’ গ্রন্থ আমাকে আরো সমৃদ্ধ করে আর এদিকের অর্থাৎ আমাদের দেশের সুন্দরবন তো কাছ থেকেই দেখেছি


নগরায়ণের ইতিহাস নিয়েও কাজ করেছেন সুন্দরবনে প্রথম মানববসতি শুরু হয় কবে থেকে?

ইতিহাসের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সুন্দরবন যেভাবে আবাদি হলো। লক্ষ্মণ সেনের সময় প্রথম সুন্দরবন আবাদ শুরু হয় অত বড় আকারে নয় একেবারেই অল্প আকারে তারপর হজরত খানজাহান আলী এসে ব্যাপকভাবে সুন্দরবন আবাদ শুরু করেন তিনি অল্প অল্প করে জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগেরহাট, খুলনায় মানববসতি শুরু করেন পরবর্তী সময়ে সুবেদার শায়েস্তা খাঁর ছেলের নেতৃত্বে আরো ব্যাপকভাবে সুন্দরবন আবাদি হয় বিশাল এলাকা আবাদি হয় তার হাত ধরে

 

সুন্দরবন এলাকায় ক্রমেই মিঠা পানির পরিমাণ কমছে এ নিয়ে কী বলবেন?

উজান থেকে যে মিঠা পানি আসে সেটা সুন্দরবন এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে সুন্দরবনের নোনা পানির সঙ্গে মিশে আলাদা একটা বাস্তুতন্ত্রের সৃষ্টি হয় সুন্দরবনের গাছপালা থেকে শুরু করে জীবজন্তু সবার জন্য এটা জরুরি উপাদান বিশেষ করে সুন্দরী গাছসহ কয়েক প্রজাতির গাছ আছে যেগুলো নিরেট লোনা পানি গ্রহণ করতে পারে না লোনা পানির সঙ্গে কিছু মিঠা পানির মিশ্রণও প্রয়োজন হয় ৭৫ সালের ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবনে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম মিঠা পানি যাচ্ছে বিশেষ করে গড়াই ও মাথাভাঙা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একটা পর্যায়ে ইছামতী নদী হয়ে বিভিন্ন নদী ঘুরে সুন্দরবনে গিয়ে লবণাক্ত পানির সঙ্গে মিঠা পানির দ্রবণ হতো এতে সুন্দরবনের গাছগুলো বেড়ে উঠত বংশ বিস্তার করত প্রাণিকুল বেঁচে থাকত কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের কারণে মিঠা পানির উৎসটা হারিয়ে গেল বিশেষ করে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট রেঞ্জে স্বাদু পানির অভাব দেখা দেয় ফলে এ অঞ্চলে সুন্দরী গাছ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে পাশাপাশি কিছু প্রাণীও বেঁচে থাকতে পারছে না খালের মধ্যে যে দেশীয় মাছ আছে সেগুলোও বেঁচে থাকতে পারছে না সুন্দরবনের বাস্তবতা এটাই

 

অতিসম্প্রতি ‘‌সুন্দরবন ও গাঙ্গেয় বদ্বীপের মোহনাশিরোনামে একটি বই লিখেছেন বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলুন

প্রথমে গাঙ্গেয় বদ্বীপ বিশ্লেষণ করি পৃথিবীর বেশকিছু বড় নদী আছে সে নদীগুলো যখন সমুদ্রে পতিত হয়, এর আগে অনেক শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তারপর উজান থেকে বালি-পলি নিয়ে এসে দ্বীপের সৃষ্টি করে মূল ধারাটা সমুদ্রে পতিত হয় ঠিকই, কিন্তু শাখা-প্রশাখা চারদিকে ছড়িয়ে যায় পলি পড়ে যে ভূমি গঠন হয় সেটা দেখতে অনেকটা ইংরেজি ডি’ অক্ষরের মতো তাই এটাকে ডেল্টা’ বলা হয় বাংলা ব’ অক্ষরের মতো বাংলায় বলা হয় বদ্বীপ গাঙ্গেয় বদ্বীপ বলার কারণ হলো, গঙ্গা ও তার শাখা-প্রশাখা মিলে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে এখানে অনেক মোহনা রয়েছে এরমধ্যে বড় মোহনা আছে অল্প কয়েকটা যেমন সবচেয়ে পশ্চিমে যে মোহনা আছে সেটা হুগলি মোহনা আর পূর্বদিকে যে মোহনা সেটা মেঘনা মোহনা এটাই সবচেয়ে বড় মোহনা হুগলি মোহনা থেকে মেঘনা মোহনা এই যে বিশাল একটা অঞ্চলএটাকেই গাঙ্গেয় বদ্বীপ বলা হয় পশ্চিমবঙ্গে তিনটি জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর এবং আমাদের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা মিলে বিশাল যে বদ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকেই আমরা গাঙ্গেয় বদ্বীপ বলি মূল প্রবাহটা গঙ্গা ও তার শাখা-প্রশাখাগাঙ্গেয় বদ্বীপের অনেকগুলো মোহনা রয়েছেতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোহনা ১৮টিসেগুলো হলো কামবাইসন, আদিগঙ্গা, হুগলি, বিদ্যাধরী, বড়তলা বা মুড়িগঙ্গা, সপ্তমুখী, ঠাকুরাণ, মাতলা, গোসাবা, হাড়িয়াভাঙা বা হরিণভাঙা, যমুনা-ইছামতী-কালিন্দী-রায়মঙ্গল, খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ, বেতনা, মরিচ্চাপ, রূপসা-পশুর-শিবসা-কুঙ্গা-মর্জাত, শিবসা, হরিণঘাটা, ভৈরব নদ, গৌরী-গড়াই-মধুমতি-বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, বলেশ্বর, শাহবাজপুর হাতিয়া-মেঘনা


সুন্দরবনের মোহনাগুলোর কী অবস্থা? সেগুলো কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাকি এখনো টিকে আছে?

এখন পর্যন্ত মোহনাগুলো তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নিতবে আমরা আশঙ্কা করছি, রামপালের মতো বড় প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের নদ-নদী জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছেমোহনাগুলো নষ্ট হওয়ার জন্যও বড় হুমকি বলে মনে করছিঅনেক শব্দ করে জাহাজ চলাচল করছে, কয়লা-তেল এসব বর্জ্য নদীতে পড়ছে; এগুলো সুন্দরবনের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেযারা দাবি করেন, মেগা প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের পরিবেশের ওপর কোনো ক্ষতি হবে না, তাদের দাবি কোনোভাবেই সঠিক নয়আমরা বারবার বলেছি, সুন্দরবনকে ক্ষতি করে কোনো বড় প্রকল্প নেয়ার যৌক্তিকতা নেই। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন