বাজেট ভাবনা

সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করা উচিত

আব্দুল বায়েস

ছবি : বণিক বার্তা

১৯৩০ শতকের মহামন্দার (গ্রেট ডিপ্রেশন) সময়কালের অন্যতম দুটো হৃদয়বিদারক ছবির একটি দেখাচ্ছে—এক মা তার চার শিশুকে বিক্রির জন্য ‘চিলড্রেন ফর সেল’ ব্যানার টানিয়ে লজ্জায় মুখ ঢাকছেন এবং অন্য ছবিতে দেখা যায় যে, বিনা পয়সায় স্যুপ খাওয়ার জন্য শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মহামন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ব্যাপক হ্রাস পায়, ২৫ শতাংশ কর্মজীবী চাকরি হারায়, শেয়ারের দাম পড়ে যায় ৯০ শতাংশ এবং সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন হাজার ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। কেউ কেউ যুক্তি দেখান, স্টক মার্কেট ক্রাশ নাকি ওই মহামন্দার শক্তিশালী উৎস। ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা বলতে লাগলেন, ও কিছু নয়, বাজারের ম্যাজিকে, ব্যক্তি উদ্যোক্তার উদ্ভাবনী শক্তির ওপর ভর করে সব স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক হয়ে যাবে। অতএব কুছ পরোয়া নেহি। কিন্তু আদতে কিছু হলো না, কেবল দারিদ্র্য ও ক্ষুধার জ্বালা ঊর্ধ্বমুখী আর সব নির্দেশক নিম্নমুখী রয়ে গেল।

জন মেইনার্ড কেইন্স নামে এক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে বললেন, একমাত্র সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি গুণক ও লিংকেজ সৃষ্টি করে ঝিমিয়ে পড়া একটা অর্থনীতিকে (বিয়ারিশ) ষাঁড়ের মতো দৌড়াতে সাহায্য করতে পারে (বুলিশ)। সুতরাং কেইন্সীয় অর্থনীতি বলে অর্থনৈতিক মন্দার সময় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি একটা মোক্ষম দাওয়াই।

বস্তুত সেই দর্শনের ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমনকি কভিড-পূর্ব বাংলাদেশে সম্প্রসারণমূলক বাজেটের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল এবং তাতে বেশ সুফল ঘরে তুলে বাংলাদেশের তিলকে উন্নয়ন ধাঁধার তকমা জোটে। তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন কার্যকারণে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবং সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি এ মুহূর্তে আশীর্বাদ না হয়ে বরং অভিশাপও হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। 

দুই. 

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন মোটাদাগে তিনটি সমস্যায় আক্রান্ত—উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে। বর্তমান সরকার এবার ক্ষমতায় এসে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব সূচকে নজর দিতে হবে ভেবেছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মূল্যস্ফীতি, রফতানি ও প্রবাসী আয়, ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশী ঋণ, রাজস্ব আয় ইত্যাদি। আরো আশ্বস্ত করেছিলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের সহ্যসীমা শূন্য (জিরো টলারেন্স) অর্থাৎ কোনো ধরনের দুর্নীতি বরদাশত করা হবে না। তবে পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। ব্যাপক ও বিস্তৃত দুর্নীতি ও বিদেশে অবৈধ অর্থ পাচার এবং অপেক্ষাকৃত কম রাজস্ব আয় অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে। অন্যদিকে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির পারদ কিছুতেই যেন নিচে নামছে না, বরং ১০ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থাৎ দুই বছর ধরে একজন দিনমজুর, রিকশাওয়ালা কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত অব্যাহতভাবে ১০০ টাকার জিনিস কিনছে ১১০ টাকায়, তা না হলে ১০০ টাকা দিয়ে ৯০ টাকার পণ্য ক্রয় করে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘খাদ্যনিরাপত্তা’ সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাবারের ক্রমবর্ধমান দাম দেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশে এখন মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মানলে, খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা ২ কোটি ৯০ লাখের বেশি পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয়। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সমস্যা অন্যখানেও—তলানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, টাকার মানে ধস ইত্যাদি। এসব সংকট সাপেক্ষে প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির হার অন্তত ২০২৩-২৪ বছরে ৬ শতাংশের নিচে থাকবে। এরই মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের হুমকি আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহকে ব্যাহত করে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্তর আরো বাড়িয়ে দিলে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। 

তিন.

প্রায় এক মাস পর জাতীয় সংসদে পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। অর্থনীতির জন্য এমন একটা অস্বস্তিকর ও পীড়াদায়ক পরিবেশে দেশের নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আসন্ন বাজেট পেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে হয়তো তিনি নতুন কিন্তু অর্থনীতির শিক্ষক, কূটনীতিক, সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক বড়। আমরা এরই মধ্যে জানতে পেরেছি যে গতবারের তুলনায় এবারের বাজেটের আকার প্রান্তিক (৫-৬ শতাংশ) কম হবে, অথচ করোনার আগ পর্যন্ত বাজেটের আকার বাড়ছিল ১০-১২ শতাংশ হারে। মূলত দুটি কারণে বাজেটের আকার বড় করা উচিত নয়। প্রথমত, ব্যয় নির্বাহের জন্য অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের অবকাশ কম; দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি বা বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সব ধরনের ব্যয় কমাতে হবে। অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির অন্যতম শক্ত নিয়ামক। সন্দেহ নেই যে এতে করে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাবে, তবে আপাতত উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের লাগাম টেনে ধরতে হলে এর বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলবেন—কেন অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও বাংলাদেশে তা অধরা; বিশেষ করে আমরা জানতে আগ্রহী বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা কেন যথাযথভাবে কাজ করছে না। 

আগামী বাজেটে আশা করব খাদ্য উৎপাদন, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষিতে ভর্তুকি এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যথাযথ মনোযোগ দেয়া হবে। সরকার কর্তৃক দেয়া ভর্তুকির সিংহভাগ রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা চেটেপুটে খায় বলে অভিযোগ আছে। সুতরাং পুরো ভর্তুকি প্রক্রিয়ার ফোকাসে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি, যাতে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল প্রবেশগম্যতা পায়। 

এ অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম। গবেষকরা বলছেন, করজাল বিস্তৃত করে, আয়কর বাড়িয়ে পরোক্ষ করের চাপ কিছুটা হলেও লাঘব করা যায়। কয়েক দশক ধরে কর সংস্কারের কথা, ব্যাংক খাত সংস্কারের কথা শুনে আসছি, অথচ এক্ষেত্রে অগ্রগতি মন্থর কেন তা জানার অধিকার জনগণের আছে। মন্দ ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? 

রিজার্ভের সমস্যা কাটাতে অবশ্যই বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে কিন্তু এত পদক্ষেপ নেয়ার পর কেন বাংলাদেশ ভিয়েতনাম, ভারত এমনকি মিয়ানমারের চেয়ে অনেক কম এফডিআই আকর্ষণ করে সে বিষয়ে চিন্তার অবকাশ আছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন একটি সূত্র ধরে বলছেন এবং জাতিসংঘও এতে একমত যে বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয়। তার মানে ৭ বিলিয়ন ডলার বা মোট প্রায় চার মাসের রেমিট্যান্স আয়ের সমান। তাছাড়া ‘বেগমপাড়া, সেকেন্ড হোম ইত্যদি বিষয়ে দুর্বলকণ্ঠ বক্তৃতা-বিবৃতির বদলে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। একজন সাবেক মন্ত্রীর বিদেশে ২৫০টি বাড়ির মালিকানা এবং ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং (রিজার্ভের ১ শতাংশ, দেশান্তরিত হওয়ার যে খবর ব্লুমবার্গ রিপোর্ট দিয়েছে তার সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রা পাচার, করমুক্ত দ্বীপরাষ্ট্রে সম্পদের নোঙর করা বৈদেশিক মুদ্রা ফিরিয়ে আনতে পারলে রিজার্ভ শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈদেশিক রিজার্ভ থেকে জাতীয় সর্বোচ্চ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনোভাবে কোনো প্রকল্প নেয়া সমীচীন নয় বলে মনে করেন এ প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। একক বিনিময় হার প্রচলন, যার মধ্যে রেমিট্যান্স প্রণোদনা যুক্ত হয়ে প্রেরকের হাতে পৌঁছবে, করতে পারলে কার্ব মার্কেটের (খুচরা বাজার) কেরামতি কমানো সম্ভব। বিদেশী বাণিজ্য সহযোগীদের সঙ্গে বিনিময় হারের আনুপাতিক ওজন নিয়ে প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার (রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট) এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে হারটি কার্ব মার্কেটের হারের কাছাকাছি থাকে। রফতানি আয়ের শতকরা ১২ ভাগ বিদেশে থেকে যাচ্ছে বলে প্রকাশ। এটা মোটেও কাম্য নয়—বড়জোর তা ৫ শতাংশ হতে পারে। এক্ষেত্রেও বৈদেশিক মুদ্রা হাতছাড়া হচ্ছে। রফতানিকারক স্পষ্ট নীতিমালার আওতায় ভিন্ন ভিন্ন খাতে সুনির্দিষ্ট হারে রিটেনশন কোটা পেয়ে থাকেন, তার পরও কেন তারা বিদেশে রফতানি আয় পার্ক করবেন—প্রশ্ন করেছেন ড. ফরাসউদ্দিন।

চার. 

যথাযথ সুশাসন নিশ্চিত করে দুর্নীতি দূরীকরণ ও আর্থসামাজিক বৈষম্য হ্রাস বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারে আছে বলে দেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যাশা করে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় আমরা তার প্রতিফলন প্রত্যাশা করি। চোখ ধাঁধানো ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দ্রুত বর্ধনশীল দুর্নীতি ও বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এ পর্যন্ত সব অর্জন বিসর্জন দিতে হতে পারে। সেই লক্ষ্যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সাপেক্ষে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি দমন ও আর্থসামাজিক বৈষম্য হ্রাসে জাতির কাছে অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকার জন্য একটানা চতুর্থবারের মতো রেকর্ডধারী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আরো কঠোর ও নির্মম হতে হবে। এবারের বাজেটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ও ফলাফল সম্পর্কিত বক্তব্য চাই, এবারের বাজেটে বৈষম্য হ্রাসে সরকারি পদক্ষেপের বিবরণী চাই। এবারের বাজেটে প্রকৃতি প্রদত্ত তাপপ্রবাহ থেকে নয়, বাজার প্রদত্ত তাপপ্রবাহ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার যথাযথ নীতিমালা চাই। 

আব্দুল বায়েস: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন