নতুন সড়ক পরিবহন আইন

দ্রুত বিধিমালা প্রণয়নপূর্বক সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে

দেশের সড়ক-মহাসড়কে হতাহতের মিছিল থেমে নেই। খোদ সরকারের হিসাবেই গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৫ হাজার ৫২৬ মানুষ, আহত হয়েছে ১৯ হাজার ৭৬৩ জন। এ হিসাবে প্রতি বছর গড়ে আড়াই হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি। রাস্তায় হতাহতের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলার প্রধান কারণ সড়ক পরিবহনে বিশৃঙ্খলা, দায়িত্বহীনতা ও অপরাধ প্রতিরোধে যুগোপযোগী আইনের দুর্বলতা। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের। ২০১০ সালে ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ সংশোধনপূর্বক যুগোপযোগী আইন করার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার খসড়া প্রণয়ন করা হলেও পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের চাপে তা প্রতিবারই আটকে যায়। মাঝে ২০১৭ সালে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভার নীতিগত অনুমোদন পেলেও তা আবার ঝুলে যায়। কিন্তু গত বছর রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠিত নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে একই বছরের ৫ আগস্ট মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায় আট বছর ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইন। আইনটি সংসদে পাস হয় চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে শুক্রবার থেকে কার্যকর হলো সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। নতুন আইনে শাস্তি বেড়েছে, এটা ইতিবাচক। আইনটি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে আইনটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনো কিছু বাস্তব সমস্যাও বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের সচেতনতা ঘাটতি। আইনটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বিআরটিএর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে এরই মধ্যে কিছু বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিতরণ করা হয়েছে সচেতনতামূলক লিফলেট। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। বলা যায়, নতুন আইনে শাস্তির পরিমাণ বেশি হলেও সেই অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা এখনো সামান্য। অনেকেই জানেন না আইনে কী শাস্তি আছে। শাস্তির মাত্রা সম্পর্কে অবহিত থাকলে আইন মানতে উদ্যোগী হবেন সর্বসাধারণ। কাজেই জনসাধারণের সচেতনতা বাড়াতে জোরদার প্রচারাভিযান চালানো দরকার। আর এ কাজ করতে হবে আইন বাস্তবায়নের সমান্তরালে। আগে প্রচারণা, পরে আইন কার্যকরএ নীতিতে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না। তাই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অচিরেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

আরেকটি সমস্যা হলো, নতুন বিধিমালা প্রণীত না হওয়া। বলা হচ্ছে, আগের বিধিমালার ভিত্তিতে আপাতত আইনটি বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু নতুন আইনে শাস্তি বাড়ানোয় অনেক ক্ষেত্রে আইনের বিভিন্ন অপব্যাখ্যার শঙ্কা থাকছে। এক্ষেত্রে অনেকেই অযথা হয়রানির শিকার হতে পারে। বর্তমানে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরে এটিই বড় সমস্যা। আইনের ভুল ব্যাখ্যা এড়ানো এবং নাগরিকের হয়রানি অবসানে আইনজ্ঞরা নতুন বিধিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দিচ্ছেন। অবশ্য এটা ঠিক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে নতুন বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ সেই কাজটি চলছে ঢিমেতালে। বিধিমালা প্রণয়নের কাজ বিলম্বিত হলে আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থেকে যাবে। তাই দ্রুত বিধিমালা প্রণয়নপূর্বক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের সক্রিয়তা প্রত্যাশিত।

এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পরও এর বিরোধিতায় বিরতি নেই পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকপক্ষের। এখনো মালিক-শ্রমিকরা আইনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা লঘু করার দাবি ত্যাগ করেননি। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছেআইনটির সব ধারাকে জামিনযোগ্য করতে হবে; সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের অর্থদণ্ড ২৫ লাখ টাকার স্থলে করতে হবে ৫ লাখ টাকা; ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণী থেকে কমিয়ে পঞ্চম শ্রেণী করতে হবে প্রভৃতি। বলতে গেলে, উল্লিখিত দাবিগুলো পূরণ করলে নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তাই আর থাকে না। কাজেই কায়েমি স্বার্থের কাছে বৃহত্তর নাগরিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে সরকারের শক্ত নৈতিক অবস্থান গ্রহণ সমীচীন হবে। তবে এটি সত্য, আইনের বিরোধী পক্ষ সংঘবদ্ধ ও প্রভাবশালী হওয়ায় নতুন আইন যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যে অত্যন্ত দুরূহ হবে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সব ধরনের অন্যায্য প্রভাব-প্রতিপ্রত্তি অগ্রাহ্য করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমরা এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দৃঢ়তাই আশা করব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন