দেশে জলবায়ুর প্রভাবজনিত বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে

অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় টেকসই উপায় খোঁজা জরুরি

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জের ধরে বাংলাদেশে বন্যা, বজ্রপাত, নদীভাঙনসহ জলবায়ুর প্রভাবজনিত দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে। দেশের অভ্যন্তরে নদী শাসন, বন ধ্বংসসহ নানা কারণে প্রকৃতি আজ বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। এর প্রভাবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। গ্রাম ছেড়ে জেলা শহরে নতুন করে আশ্রয় গড়ে তুলেছে উপকূলীয় এলাকার ধনী ও সচ্ছল প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবার। বিপরীতে দরিদ্ররা ভিটেমাটি হারিয়ে ভাসমান মানুষের মিছিলে শামিল। কেননা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বড় ধরনের দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র লোকেরা। এভাবে দেশের অভ্যন্তরে চলছে এক নীরব অভিবাসন। ভিটেমাটি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত জীবন গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। ইন্টারনাল ডিসপ্লেস মনিটরিং সেন্টার প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ১২ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের অভ্যন্তরেই বাস্তুচ্যুত জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। সার্বিক পরিস্থিতিতে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় টেকসই উপায় খোঁজা জরুরি।

মনে রাখতে হবে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা জীববৈচিত্র্যসহ দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বে। জীবনমান হ্রাস পাবে। বেকারের সংখ্যা বাড়বে। ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়া। বিষয়টি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে টেকসই কার্যক্রম ও কর্মসূচির বিবেচনা করা জরুরি। শুধু তহবিলের ব্যবস্থা করলে চলবে না, ওই তহবিলটি ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছল কিনা এবং তাদের কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন রাষ্ট্র নানা ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। সুইডেনে যেমন জলবায়ুবিষয়ক একটি আইন করা হয়েছে, যেখানে ২০৪৫ সালের মধ্যে দেশটির সরকারকে সব ধরনের গ্রিনহাউজ নির্গমন হ্রাস করতে হবে। পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তি সম্পর্কিত নীতি চালু করেছে ভারত সরকারও। ২০৫০ সালের মধ্যে ডেনমার্ক জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে মুক্ত হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশকেও প্রস্তুতি নিতে হবে। কেননা অচিরে জলবায়ুসংক্রান্ত বিপর্যয়ের ঘটনা বাড়বে, যার নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেমন সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েছে।

এদিকে সারা দেশে যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে সাতক্ষীরায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাইনাস দশমিক ৪ শতাংশ। কারণ সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার মানুষ বসতভিটা, স্থায়ী আবাস ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। আইলা-পরবর্তী হাজারের বেশি পরিবার নিরাপদ আশ্রয় ও কাজের সন্ধানে অন্যত্র অভিবাসন গ্রহণ করেছে। অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের এ হার ক্রমে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে অভিবাসনের হার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, দেশে বর্তমানে গড় বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অথচ খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের নিচে। শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারেই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দারিদ্র্য মোকাবেলায়ও পিছিয়ে রয়েছে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ অন্যদের তুলনায় সবচেয়ে বেশি জিডিপি হারাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশের ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। জিডিপির ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ক্ষতি হবে।জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেবাংলাদেশ চ্যাপ্টারে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ জিডিপিতে ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৭১ বিলিয়ন ডলার। এতে আশঙ্কা করা হয়েছে, বাংলাদেশের চার-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যেতে পারে।

এদিকে আইলা-পরবর্তী অনেক পরিবার এখনো পুনর্বাসিত হতে পারেনি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাসমান জীবনযাপন করছে। এক্ষেত্রে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ভুক্তভোগী গ্রাম ও এলাকার মানুষদের সচেতন করতে হবে। বাস্তুচ্যুতদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করতে হবে। সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশকে তার প্রস্তুতিগুলো স্পষ্ট করা জরুরি। খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, পানিনিরাপত্তার পাশাপাশি জ্বালানিনিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি স্বাস্থ্যনিরাপত্তার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বিদ্যমান। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলাসংক্রান্ত কাজগুলো করার জন্য যে সমন্বয় প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রে তার অভাব রয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারেও বিশ্বের অন্যদের তুলনায় আমরা পিছিয়ে রয়েছি। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে গৃহীত কর্মকাণ্ডগুলো স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করা চাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন