সিল্করুট

রত্নগিরিতে বর্মি রাজার নির্বাসন

নিজাম আশ শামস

রাজা থিবাউকে নিতে এসেছে ব্রিটিশ সেনা শিল্পী: সায়া শোন

রাজা থিবাউ মিন বার্মার উপকূল ত্যাগ করার দিনই মান্দালয়ের রাজপ্রাসাদে রাজকীয় সাদা হাতিটি মারা যায়। এটি ছিল অশনিসংকেত। রাজপরিবারের জন্য। বার্মার অধিবাসীদের জন্যও বটে। হাতিটি মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই বার্মা তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল। ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি লর্ড ডাফরিন বার্মাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন।

জাহাজের নাম থুরিয়া। স্কটিশ মালিকানাভুক্ত ‘ইরাবতী ফ্লোটিলা কোম্পানি’র একটি স্টিমার। ১৮৮৫ সালের ২ ডিসেম্বর এটি বার্মার মান্দালয় শহর থেকে যাত্রা করে। আরোহী রাজা থিবাউ মিন ও তার পরিবার। প্রাথমিকভাবে সহযাত্রী ছিল ৮০ জন। তারা ভেবেছিল যে রাজাকে ইয়াঙ্গুনে নির্বাসন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ভারতে পাঠানো হচ্ছে জানতে পেরে অধিকাংশই মান্দালয়ে ফিরে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৭ জন পরিচারিকা, দুজন অমাত্য ও একজন দোভাষী রাজপরিবারের সঙ্গে ভারতে গিয়েছিল। থুরিয়ায় দায়িত্বরত কর্মকর্তারা রাজপরিবারের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছিলেন। ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাফরিন এ মর্মে কর্মকর্তাদের কাছে স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন। ছয়দিন পর জাহাজটি রেঙ্গুনে পৌঁছায়। সেখান থেকে মাদ্রাজগামী একটি স্টিমারে রাজপরিবারকে তোলা হয়। মাদ্রাজে সাময়িক অবস্থানের পর রাজপরিবারকে আরেকটি জাহাজে তোলা হয়েছিল। জাহাজের নাম ছিল ক্লাইভ। যাত্রার ধারাবাহিকতায় রত্নগিরি বন্দরে থামে সে জাহাজ। ততদিনে থিবাউ মিনের জানা হয়েছে যে এ নির্বাসনের মেয়াদ আমৃত্যু। বার্মা মুলুকে কখনো ফেরা হবে না আর! 

তৃতীয় অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের সূত্র ধরে রাজা থিবাউ মিনকে রত্নগিরিতে নির্বাসন দিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৮৮৫ সালের নভেম্বরে এ যুদ্ধ হয়েছিল। থিবাউ মিনের নির্বাসনের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে ভারত ও বার্মার মধ্যে অসংখ্য চিঠি ও টেলিগ্রাম চালাচালি হয়েছিল। লর্ড ডাফরিন ভারতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহরে থিবাউকে নির্বাসনের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই প্রাথমিকভাবে মাদ্রাজসহ বিভিন্ন শহরের নাম প্রস্তাবিত হলেও সেগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়। অবশেষে রাজা থিবাউকে রত্নগিরিতে নির্বাসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

রত্নগিরি। ভারতের পশ্চিমে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত বন্দর। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার লেশমাত্র ছিল না তখন। কোনো রেল যোগাযোগও ছিল না। সেখানে সপরিবার জীবনের ৩০টি বসন্ত অতিবাহিত করেছিলেন থিবাউ মিন। বার্মার কোনবং সাম্রাজ্যের শেষ রাজা। দেশটির ইতিহাসের সর্বশেষ রাজাও বটে। রত্নগিরিতে তিনি অবকাশ যাপন করতে যাননি। হাওয়া বদলও উদ্দেশ্য ছিল না। সেখানে সপরিবার তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল।

রাজপরিবারের বসবাসের জন্য রত্নগিরির সবচেয়ে সুন্দর বাংলো দুটি ভাড়া নেয়া হয়েছিল। আউটর‍্যাম হল ও বেকার’স বাংলো। আউটর‍্যাম হলে কর্মচারীরা থাকতেন। রাজপরিবার ও পুলিশ কর্মকর্তা ফ্যানশের জন্য বরাদ্দ ছিল বেকার’স বাংলো। রাজপরিবারের জন্য বেকার’স বাংলোকে সুসজ্জিত করা হয়েছিল। ড্রইং রুমের মেঝেতে বিছানো হয়েছিল পারস্য থেকে আনা দামি গালিচা। ড্রইং ‍রুমের বাম পাশের দুটি বেডরুমে রাজপরিবারের সদস্যরা থাকতেন। তার পেছনের একটি বেডরুমে থাকতেন ফ্যানশ। প্রতিটি কক্ষ চমৎকার সব আসবাবপত্রে পরিপূর্ণ ছিল। ড্রইং রুমের ডান পাশে ছিল ডাইনিং রুম ও থিবাউ মিনের পড়ার ঘর। সেখানে একটি ডেস্ক, কয়েকটি চেয়ার ও একটি বুকশেলফ ছিল। বাংলোর টানা বারান্দায় পাতা ছিল সারি সারি চেয়ার। রাজপরিবারের সেবার জন্য ব্রিটিশ সরকার ২৫ জন পরিচারক ও ছয়জন পরিচারিকা নিয়োগ দিয়েছিল। বাংলোর সামনে দুটি ঘোড়ার গাড়ি সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকত। বাংলো দুটি ছিল পশ্চিমমুখী। পারস্পরিক দূরত্ব ছিল ৪০০ গজ। নারিকেল বাগানের আড়ালে ঢাকা। রাজপরিবারের প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের থাকার জন্য তিনটি চৌকি স্থাপন করা হয়েছিল। তারা রাজা থিবাউর প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখতেন। পুলিশ প্রধান ছিলেন ফ্যানশ। রাজার সঙ্গে কেউ দেখা করার আগে তার অনুমতি নিতে হতো।

১৮৮৬ সালের ১৬ এপ্রিল রাজা থিবাউ মিন তার দুই স্ত্রী সুপায়ালাত ও সুপেয়াগেলিকে নিয়ে রত্নগিরি পৌঁছলেন। রত্নগিরিতে তখন প্রায় ১১ হাজার মানুষের বসতি। সরকারি কর্মকর্তাদের সংখ্যা সীমিত। সেখানে একটি রেভিনিউ সার্ভে অফিস, কাস্টম হাউজ, জেলখানা, পোস্ট অফিস, কয়েকটি স্কুল ও গির্জা ছিল। অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। ইউরোপীয় কর্মকর্তা ও মিশনারিদের জন্য একটি ক্লাব ছিল। সেখানে লাইব্রেরি, রিডিং রুম, র‍্যাকেট কোর্ট, সুইমিং পুল, বাগানসহ বিনোদনের নানা ব্যবস্থা ছিল।

প্রথম দিন থেকেই রত্নগিরিকে রাজা থিবাউ মিন ও তার দুই রানী পছন্দ করতে পারেননি। পুলিশ কর্মকর্তা ফ্যানশের অনুমতি নিয়ে ভাইসরয়ের কাছে এ মর্মে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন থিবাউ। তিনি রত্নগিরিকে বার্মার কাচিন ও কারেনের মতো দুর্গম গ্রামের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তার মতে, রত্নগিরি বসবাসের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। সেখানে প্রচুর সাপ ও বিছার বিচরণ বলে ভাইসরয়কে অবহিত করেন থিবাউ মিন। রত্নগিরির ভারী বর্ষণও তার কাছে অসহ্য ঠেকছিল। তাকে সপরিবার বার্মায় ফেরত পাঠানোর জন্য ভাইসরয়ের কাছে অনুরোধ জানান। সেজন্য ব্রিটিশ সরকারের যেকোনো শর্ত মেনে নিতেও তিনি রাজি ছিলেন। কিন্তু তার এ আবেদন নাকচ হয়ে যায়। তখন তিনি ভারতবর্ষের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহরে যাওয়ার আবেদন করেন। ব্রিটিশ সরকার তাও কবুল করল না। 

ব্রিটিশ সরকার রাজা থিবাউ মিনকে নির্বাসন দিয়েছিল। মানুষের মন থেকে তার স্মৃতি মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা রাজপরিবারের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছিল। সপ্তাহে দুবার ফলমূল ও বরফ আসত মুম্বাই থেকে। বাংলোর সামনে একটি আইস মেশিন স্থাপন করা হয়েছিল। বিস্কুট ও শুকনো ফলের টিন থাকত পর্যাপ্ত। দুধ সরবরাহের জন্য একটি গরুর খামার ছিল। রাজপরিবারের পছন্দের শূকরের মাংসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য ছিল দুটি খোঁয়াড়। গ্রীষ্মকালে পাখা টানার জন্য দিনরাত পরিচারক ও পরিচারিকা নিয়োজিত থাকত। রাজপরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের ভার ছিল সিভিল সার্জনের ওপর। রাজা থিবাউকে ইংরেজি শেখানোর জন্য একজন শিক্ষকও নিয়োগ দিয়েছিল সরকার।

নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থাকলেও রাজা থিবাউ মিনের জন্য বরাদ্দ ভাতার পরিমাণ ছিল সীমিত। ছোট বাংলোতে থাকতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে মুম্বাইয়ের তৎকালীন গভর্নর লর্ড ল্যামিংটনের কাছে চিঠি লেখেন থিবাউ মিন। তিনি শহর থেকে কিছু দূরে একটি বাড়ি নির্মাণের অনুরোধ জানান। একই চিঠিতে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বার্ষিক ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাবও রাখেন। প্রস্তাবকে জোরদার করতে তৎকালীন কালেক্টর, অফিসার ইনচার্জ ও সিভিল সার্জনের রেফারেন্সও দেন থিবাউ মিন। প্রস্তাব আমলে নিয়ে ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ সরকার তার জন্য একটি প্রাসাদ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তদনুসারে ২৭ একর জায়গায় ১ লাখ ২৫ হাজার রুপি ব্যয়ে নির্মিত হয় রাজকীয় বাসভবন। ল্যাটেরাইট ও লাভা রক দিয়ে তৈরি দ্বিতল প্রাসাদ। এর ছাদ ছিল টালির তৈরি। মার্বেল পাথর ও টাইলস দিয়ে মেঝে সুসজ্জিত করা হয়েছিল।  লোকমুখে ‘থিবাউর প্রাসাদ’ নামে তা পরিচিতি পায়। এ প্রাসাদে একটি বড় দরবার হল ছিল। মূল দালানে ১৬টি প্রশস্ত কক্ষ ছিল। সেগুলোর সম্মিলিত আয়তন ছিল ২৫ হাজার বর্গফুট। কক্ষগুলোর মেঝে সুদৃশ্য গালিচায় মোড়ানো ছিল। পরিচারকদের জন্য ছিল ৬০টি কক্ষ। আস্তাবলে ছয়টি ঘোড়া ছিল। গ্যারেজে তিনটি ঘোড়ার গাড়ি ও একটি মোটর কার ছিল। দুটি রান্নাঘর ও দুটি ভাঁড়ার একটি গলিপথের মাধ্যমে মূল ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সুপেয় পানির জন্য দুটি কূপ খনন করা হয়েছিল। প্রাসাদটি পশ্চিমমুখী ছিল। প্রাসাদ থেকে আরব সাগরের দৃশ্য উপভোগ করা যেত। রাজা থিবাউর জন্য বার্ষিক ভাতাও বরাদ্দ রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার। প্রাথমিকভাবে এ ভাতা বার্ষিক ৩৫-৪২ হাজার রুপির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯০৬ সালে বার্ষিক ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে ১ লাখ রুপি করা হয়। এর মধ্যে মাসিক ৫ হাজার রুপি হিসেবে বার্ষিক পেনশন ৬০ হাজার রুপি, পোশাক ভাতা মাসিক ১২৫ রুপি হিসেবে বার্ষিক ৬ হাজার রুপি, উৎসব ভাতা বার্ষিক ১৫ হাজার ৫০০ রুপি, রিজার্ভ ফান্ডে সংরক্ষণের জন্য বার্ষিক ১৮ হাজার ৫০০ রুপি বরাদ্দ ছিল।  রত্নগিরিতে তিনি নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতেন। স্থানীয়দের সঙ্গে তার মেলামেশা ছিল না। এমনকি তিনি প্রাসাদ থেকে বেরও হতেন না। তবে দাতা হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। আঞ্চলিক বিভিন্ন উৎসবে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। বিশেষ করে দীপাবলি উৎসবে তিনি বেশ খরচ করতেন। থিবাউ মিনের প্রত্যক্ষ‌ নির্দেশনায় প্রাসাদ চত্বরে আয়োজিত আতশবাজির প্রদর্শনী ছিল স্থানীয়দের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। সাধারণত প্রাসাদের দরবার হলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। তবে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রাসাদ চত্বরে প্যান্ডেল খাটানো হতো। সেখানে অতিথিদের আপ্যায়নের নানা বন্দোবস্ত থাকত। অতিথিদের রেশমের ধুতি উপহার দিতেন রাজা থিবাউ মিন। এসব কাপড় মুম্বাই থেকে কেনা হতো কিংবা বার্মা থেকে আমদানি করা হতো। বরাদ্দ ভাতা থেকে এতকিছু করা সম্ভব ছিল না। তাই থিবাউকে প্রায়ই তার ধনরত্ন বিক্রি করতে হতো। ধারদেনাও করতেন প্রচুর। মুদি দোকানদারসহ পরিচিত সবার কাছ থেকেই তিনি ধার করতেন। তার অমিতব্যয়িতার বয়ান দিতে গিয়ে রত্নগিরির এক কালেক্টর লিখেছেন, ‘তিনি বেশ দয়ালু ছিলেন। পাপমুক্ত ছিলেন। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। অল্পতেই তুষ্ট ছিলেন। সুখী ছিলেন। তবে তার একটি দোষ ছিল। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তিনি একেবারেই অদক্ষ ছিলেন। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে জলের মতো অর্থ গড়িয়ে পড়ত। তার ব্যয় সীমিত করা অসম্ভব ছিল। অর্থ ব্যয় করা ছিল তার অন্যতম শখ।’ ১৯১০ সালে রত্নগিরির কালেক্টরের দেয়া এক হিসাব অনুযায়ী, সে সময় থিবাউ মিনের ঋণের পরিমাণ ছির ৬০ হাজার ৭০০ রুপি। তার মাসিক সুদের পরিমাণই ছিল ৩ হাজার ২৬০ রুপি। অথচ সে সময় তার মাসিক পেনশনের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫০০ টাকা। ‘এক্স কিং থিবাউস অ্যাক্ট, ১৮৯৫’ অনুসারে এ বিপুল পরিমাণ দেনা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। এ আইন অনুসারে থিবাউ মিনের ঋণ নেয়ার অনুমোদন ছিল না। তাই তিনি ঋণ পরিশোধেও বাধ্য নন। রত্নগিরির কালেক্টরের নির্দেশে থিবাউ মিনকে ঋণ দেয়া মহাজনদের প্রাসাদে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। থিবাউর প্রাসাদে পরিচারক ও অধীনদের জন্য অনেক কোয়ার্টার ছিল। তারা সবাই ছিলেন মারাঠি। রত্নগিরিতে প্রথম মোটর গাড়ির মালিক ছিলেন থিবাউ মিন। কিন্তু তাতে কখনো চড়েননি তিনি। মুম্বাইয়ের গভর্নর একবার রত্নগিরি পরিদর্শনে আসার পর গাড়িটি ব্যবহার করতে চাইলে থিবাউ মিন অনুমতি দেননি। এটি ছিল দুই সিলিন্ডারের একটি গাড়ি। মডেল ১০/১২ এইচপি ডে ডিয়ন কার। গাড়িটি নিয়ে মজার তথ্য দিয়েছেন সুধা শাহ। পারুলকর নামে রত্নগিরির এক অধিবাসীর বরাতে তিনি লেখেন, ‘রত্নগিরি জেলায় রাজা থিবাউর মোটর গাড়িটিই ছিল প্রথম। সাধারণ মানুষ আভূমি নত হয়ে এটিকে প্রণাম করত। এর সামনে ঘাস রাখত। কারণ তারা ভাবত যে গাড়িটির খেতে হয়! তারা মনে করত যে এটি গরু কিংবা ঘোড়ায় টানা নতুন কোনো গাড়ি!’ মোটর গাড়ি কেনার জন্য ব্রিটিশ সরকার থিবাউ মিনকে রিজার্ভ ফান্ড থেকে ১০ হাজার রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল। ১৯০৯ সালে রাজা থিবাউ মিন রিজার্ভ ফান্ড থেকে ৫ হাজার রুপির জন্য আবেদন করেন। এ অর্থ দিয়ে তিনি প্রাসাদ চত্বরে রানীদ্বয় ও রাজকুমারীদের জন্য একটি ‘সামার হাউজ’ নির্মাণ করেন। রত্নগিরিতে থিবাউ মিনের অবস্থানের বিশদ বিবরণ ‘বার্মা কিংস ফাইল’ নামে দুটি বড় ভলিউমে লিপিবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৩৫ সালের দিকে ভলিউম দুটি নষ্ট হয়ে যায়। 

রত্নগিরির নির্বাসিত জীবনে রাজা থিবাউ মিন ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। দিনে দুইবার (সকাল ও সন্ধ্যায়) তিনি ‘ত্রিরত্ন’ তথা বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের প্রার্থনা করতেন। ‘দ্য কিং ইন এক্সাইল’ নামে থিবাউ মিনের জীবনী রচনা করেছেন সুধা শাহ। বইটিতে রাজা থিবাউ মিনের এক নাতির বরাতে চমৎকার একটি কথোপকথন উল্লেখ করেছেন তিনি। কথোপকথনটি রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাতের মধ্যে হয়েছিল। একদিন থিবাউ প্রার্থনা সমাপ্ত করলে সুপায়ালাত তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘প্রার্থনার পর তুমি কী কামনা করো?’ থিবাউ উত্তর দিলেন, ‘আমি সবার শান্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।’ সুপায়ালাত বললেন, ‘সবার মধ্যে তুমি ব্রিটিশদের অন্তর্ভুক্ত করো না।’ থিবাউ বললেন, ‘এভাবে বলে না প্রিয়, ব্রিটিশরাও তো মানুষ!’ সুপায়ালাত ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘মানুষ! তারা আমাদের শত্রু। দেখো, তারা আমাদের কী অবস্থা করেছে। ব্রিটিশদের কারণেই আমরা কষ্ট পাচ্ছি। তাই তুমি তাদের কোনো আশীর্বাদ করবে না!’ এ কথোপকথন থেকে ব্রিটিশদের প্রতি রানী সুপায়ালাতের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। এটাও বোঝা যায় যে ক্ষমতাচ্যুত নির্বাসিত জীবনে রাজা থিবাউ মিনের মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। ব্রিটিশদের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। তার তখনকার জীবন থেকে আন্দাজ করার কোনো উপায় নেই ক্ষমতায় থাকাকালে রানী সুপায়ালাতের পরামর্শে তিনি ৮০ জন জ্ঞাতিকে হত্যা করেছিলেন! কোনবং সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য সব উত্তরাধিকারীকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য। রাজা থিবাউ মিনের মানসিকতার এ পরিবর্তনের কারণে সুপায়ালাত তার প্রতি বিরক্ত ছিলেন। তার মতে, থিবাউ মিন নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি অত্যধিক ধার্মিক ছিলেন। তার মতো মানুষের রাজা হওয়া উচিত নয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু হলেই বরং তিনি ভালো করতেন। রানী সুপায়ালাত আমৃত্যু ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেছিলেন। তার সন্দেহ ছিল যে ব্রিটিশরা খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে রাজপরিবারের সদস্যদের হত্যা করবে।

রত্নগিরিতে রাজা থিবাউ মিনের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের একটি বিবরণ পাওয়া যায় তার এক সচিবের বরাতে। বিবরণী অনুসারে, তিনি সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠতেন। ৯টায় সকালের নাশতা সারতেন। দুপুরের খাবার খেতেন ১২টায়। বিকাল ৫টায় তিনি চা খেতেন। রাত ৯টায় সারতেন ডিনার। মাঝরাতে তিনি ঘুমাতে যেতেন। বিকালে দর্শনার্থীরা রাজা থিবাউ মিনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেতেন। জুতা নিয়েই তারা প্রাসাদে প্রবেশের অনুমতি পেতেন। চেয়ারেও বসতে পারতেন। তবে রাজা থিবাউ মিন তাদের তুলনায় উঁচু আসনে বসতেন। 

রানী সুপায়ালাত নিয়মিত রান্না করতেন। প্রতিদিন প্রার্থনা করতেন। টেবিল ক্লথ ও মাদুর বুনতেন। বার্মার খবর জানার জন্য ‘হানথাওয়াডি ডেইলি’ ও ‘মিয়ানমার অ্যালিন’ নামে দুটি সংবাদপত্র পড়তেন। তার এক নাতনির বরাতে সুধা শাহ লেখেন, ‘প্রায় সময় তিনি সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি তার ঘরের কথা ভাবতেন। তার হৃত ক্ষমতার কথা ভাবতেন। মান্দালয়ের রাজপ্রাসাদে তার কর্তৃত্বের কথা ভাবতেন। তার বন্দিদশা নিয়ে তিনি সব সময় বিমর্ষ থাকতেন।’ পর্যায়ক্রমে তার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। মানসিকভাবেও খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান।

১৯১২ সালের ২৮ জুন থিবাউ মিনের ছোট রানী সুপেয়াগেলি মারা যান। ১২ বছর ধরে তিনি গ্যাস্ট্রিকে ভুগেছিলেন। থিবাউ তার দেহাবশেষ মান্দালয়ে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বার্মার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর অনুমতি দেননি। বাধ্য হয়ে প্রাসাদ চত্বরেই তাকে সমাহিত করা হয়।

শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ব্রিটিশরা রেঙ্গুনে নির্বাসন দিয়েছিল। আর রাজা ‍থিবাউ মিনের কপালে জুটেছিল রত্নগিরি। মাতৃভূমি থেকে তাকে যথাসম্ভব দূরে নির্বাসন দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল ব্রিটিশরাজ। বাহাদুর শাহ জাফরের মতো তিনিও স্বভূমে ফেরার আকুতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু মঞ্জুর হয়নি। তার সমাধিও রচিত হলো বিভুঁইয়ে। 

১৯১৬ সালের জুলাইয়ে থিবাউ মিন বেশ অসুস্থ হয়ে যান। ১৫ ডিসেম্বর অবস্থার বেশ অবনতি ঘটে। জরুরি ভিত্তিতে সিভিল সার্জনকে ডেকে পাঠানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর মারা যান বার্মার শেষ রাজা থিবাউ মিন। ১৯১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তার শ্রাদ্ধের আয়োজন করা হয়। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৫ হাজার রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল। ১৯১৯ সালের ১৯ মার্চ রত্নগিরিতে তার সমাধি নির্মাণ করা হয়। আজও তা বার্মার শেষ রাজা থিবাউ মিনের স্মৃতি বহন করছে।

সূত্র: সুধা শাহ, দ্য কিং ইন এক্সাইল

নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক