উদ্যোক্তা ভাবনা

ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সিং পলিসি ২০২৪ এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য বন্ড ব্যবস্থা

ফেরদাউস আরা বেগম

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

বাংলাদেশে শতভাগ রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের রফতানিযোগ্য কাঁচামালের জন্য আমদানীকৃত কাঁচামাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজের মাধ্যমে শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করতে পারে, যা তাদেরকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রতিযোগী হতে বিশেষভাবে সহায়তা করে। অন্যদিকে যেসব উদ্যোক্তা বন্ডেড ওয়্যারহাউজের সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয় অর্থাৎ শতভাগ রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান নয়, তারা শুল্ক (ডিউটি) ড্র ব্যাক নেয়ার সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। তবে এ শুল্ক ড্র ব্যাক পেতে উদ্যোক্তাদের অপেক্ষা করতে হয় এবং হয়রানিও হতে হয়। আবার মূসক আইন-২০১২ বাস্তবায়নের ফলে সব ধরনের শুল্ক ফেরত শুল্ক অব্যাহতি (ডিউটি এক্সেম্পসন) ড্র ব্যাক অফিস বা ডেডো থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়েছে। আংশিক রফতানিকারকদের জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউজের ব্যবস্থার কথা আমদানি নীতিতে উল্লেখ থাকলেও তা এ-যাবৎ বাস্তবায়ন হয়নি। এসব কারণে রফতানি বহুমুখীকরণ পিছিয়ে পড়েছে। যদিও রফতানি পণ্যের তালিকায় সহস্রাধিক পণ্যের উদাহরণ আছে, যেগুলো রফতানিযোগ্য অথচ নীতিমালার সুবিধার অভাবে রফতানি সম্ভব হচ্ছে না। আংশিক রফতানিকারকদের জন্য সহজ বন্ডেড ওয়্যারহাউজের ব্যবস্থা অথবা কমন বন্ডেড ওয়্যারহাউজের নীতি প্রণয়ন করা হলে অনেক নতুন পণ্য রফতানি সম্ভব হতে পারে। পরবর্তী সময়ে এগুলোই হয়তো শতভাগ রফতানিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে। 

সম্প্রতি কাস্টমস আইন-২০২৩ (২০২৩ সালের ৫৭ নং আইন)-এর ২৬৩ ও ১২ ধারার উদ্দেশ্যে পূরণকল্পে, প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সিং পলিসি-২০২৪ প্রণয়ন করা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের ৬ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে। এর আওতায় সরাসরি রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান, প্রচ্ছন্ন রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান, ডিপ্লোমেটিক বন্ড প্রতিষ্ঠান, ডিউটি ফ্রি বন্ড প্রতিষ্ঠান, ডিউটি পেইড বন্ড প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ও বেসরকারি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অবস্থিত সরাসরি ও প্রচ্ছন্ন রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান; রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা এবং বাণিজ্যিক এলাকায় স্থাপিত সরাসরি ও প্রচ্ছন্ন রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্কে অবস্থিত সরাসরি ও প্রচ্ছন্ন রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ বিধিমালার আওতাভুক্ত হবে। 

নতুন ওয়্যারহাউজ পলিসি-২০২৪-এ বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়, বাস্তব অর্থে রফতানিকারকদের জন্য ওয়্যারহাউজ একটি অপরিহার্য ব্যবস্থা। তবে এ পলিসিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি। যে কারণে তারা বাণিজ্যিক আমদানিকারকের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি দামে কাঁচামাল ক্রয় করে থাকে এবং সঠিক কাগজপত্রের অভাবে মূসক ক্রেডিট নিতে পারে না। তাই তারা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারান।

নতুন নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ফলে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য খাতের কিছু সুবিধা হতে পারে। কাস্টম অ্যাক্ট-১৯৬৯ এ আমরা দেখতে পাই যে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ নীতিতে ধারা-১৩ এবং ধারা-৮৪-১১৯ বিবেচনা করা হয়েছে এবং শিরোনাম ছিল ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সিং রুল-২০০৮’। অন্যদিকে কাস্টম অ্যাক্ট ২০২৪ এ ধারা-১২ ও ধারা-২৬৩-এর অধীনে নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং আগের শিরোনাম থেকে ‘বন্ডেড’ শব্দটি বাদ দিয়ে নতুন শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সিং রুল-২০২৪’। 

অন্যতম পরিবর্তনের মধ্যে লক্ষণীয় হলো, কাস্টম অ্যাক্ট-১৯৬৯-এর লাইসেন্সিং ফি ছিল ৫০ হাজার টাকা এবং নবায়ন ফি ছিল ৫ হাজার টাকা। কাস্টম অ্যাক্ট ২০২৪-এর আইনে এ ফি বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। নতুন লাইসেন্সিং ফি এবং নবায়ন ফি যথাক্রমে ১ লাখ টাকা এবং ১০ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০০৮ সালে যে নীতিমালা হয়েছিল তার তুলনায় ১৫ বছর পর লাইসেন্সিং ফি এবং নবায়ন ফি বাড়তেই পারে। তবে এর সঙ্গে সময় এবং পদ্ধতিগত সহজীকরণ এবং একই সঙ্গে আর কোনো ধরনের অনানুষ্ঠানিক খরচ দরকার হবে না—এমন নিশ্চয়তা থাকলে উদ্যোক্তা অতিরিক্ত খরচ করতে অনীহা প্রকাশ করবে না। এ আইনে অবশ্য সব ফি প্রদান এবং দলিলাদি প্রদান সাপেক্ষে ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে লাইসেন্স প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটলে তা যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। 

কাস্টম অ্যাক্ট-১৯৬৯ অনুসারে লাইসেন্সের মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু কাস্টম অ্যাক্ট-২০২৪ অনুসারে এক বছর বৃদ্ধি করে তিন বছর করা হয়েছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ, এতে সব ধরনের উদ্যোক্তার প্রতি সমতা আনা হলো, পূর্বে শুধু তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা ছিল। 

এছাড়া ১৯৬৯-এর আইনে প্রতি বছর অডিট রিপোর্ট জমা দিতে ২২টি ডকুমেন্ট জমা দিতে হতো। ২০২৪-এর আইনে অডিট রিপোর্টের প্রয়োজনীতা যেকোনো দুই বছরের মধ্যে রাখা হয়েছে এবং নবায়ন করার ক্ষেত্রে ডকুমেন্টের সংখ্যা ২৩ করা হয়েছে। এখানে ছয় মাসের কার্যকর কার্যক্রমের (অপারেশন) প্রমাণপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সেকশন সংখ্যার মধ্যেও বেশ পার্থক্য দেখা যায়। পূর্বে সেকশন সংখ্যা ২০টি থাকলেও কাস্টম অ্যাক্ট-২০২৪-এ নতুন সেকশন যুক্ত করে ২৭টি করা হয়েছে। 

নতুন আইনে বন্ডিং সময়সীমা ও ওয়্যারহাউজের ধারণক্ষমতা বাড়ানোর মতো কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তন দেখা যায়। বন্ডেড ওয়্যারহাউজ (বিডব্লিউএইচ) লাইসেন্সের জন্য কাস্টম অ্যাক্ট ১৯৬৯-এ দুটি ফর্মের প্রয়োজন হলেও তা পরিবর্তন করে কাস্টম অ্যাক্ট-২০২৪-এ শুধু একটি ফর্ম ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া কাস্টম অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর আইনে ইলেকট্রনিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু ২০২৪ সালের আইনে নতুন কিছু সেকশন/সংজ্ঞা যুক্ত করা হয়েছে। যেমন শিডিউল, উপযুক্ত রফতানি নির্ভর শিল্প ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। এতে আইনটি আরো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। 

কিছু নতুন নীতির সংযুক্তিই কাস্টম অ্যাক্ট-১৯৬৯ ও কাস্টম অ্যাক্ট ২০২৪-এর মধ্যে প্রধান পার্থক্য। কাস্টম অ্যাক্ট ২০২৪-এ বেশকিছু নতুন নীতিমালা সংযোজন করা হয়, যেমন বন্ডেড ওয়্যারহাউজের ধারণক্ষমতা এবং বন্ডিং সময়সীমা (ধারা: ৭), যন্ত্রপাতি স্থাপন ও সংযুক্তি (ধারা:৮), নিরীক্ষা (ধার: ১১), লিয়েন ব্যাংক (ধারা: ১৫), শিল্প স্থানান্তর (ধারা: ১৯) ও মালিকানা স্থানান্তর (ধারা: ২০)। তবে কাস্টম অ্যাক্ট ২০২৪-এ যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়নি সেগুলো হলো পূর্বের মতোই রেডিমেড (RMG) খাতকে বিশেষ বন্ডের আওতায় রাখা হয়েছে, এ বিষয়ে অন্য খাতের উদ্যোক্তাদের কিছুটা আগ্রহ ছিল। 

কিন্তু নতুনভাবে ডিজাইন করা পণ্যের জন্য স্বত্বাধিকারী (এনটাইটেলমেন্ট), রফতানিভিত্তিক খাতের (এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড সেক্টর) জন্য সাবকন্ট্রাক্টিং, নমুনা (স্যাম্পল) আমদানি পাসবুক, শতভাগ রফতানিমুখী শিল্পের জন্য সম্প্রসারিত বন্ডেড ওয়্যারহাউজ এবং সাধারণ বন্ডেড ওয়্যারহাউজ এ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। 

কাস্টম অ্যাক্ট-২০২৪-এ মূলত আধুনিকায়নের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে, সেখানে ফি বৃদ্ধি, লাইসেন্সের মেয়াদ বাড়ানো এবং নতুন সংজ্ঞার মাধ্যমে কার্যক্রমের প্রসারণ ঘটানো হয়েছে। কাস্টম অ্যাক্ট-১৯৬৯ ও কাস্টম অ্যাক্ট-২০২৪-এর মধ্যে পার্থক্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে কাস্টম অ্যাক্ট-২০২৪ মূলত আধুনিকায়নের দিকে বেশি নজর দিলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পূর্ববর্তী নীতি থেকে বাদ দেয়ার কারণে নতুন কাঠামোর পূর্ণতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

অব্যাহত বন্ড সুবিধা (Continous Bond) এ নীতির আরেকটি বড় সুবিধা অর্থাৎ একই মালিকানাধীন একই প্রতিষ্ঠানের আওতায় একাধিক স্থানে একই কমিশনারেটের অধিক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন স্তরে উৎপাদন ইউনিটের কার্যক্রমকে মূল ওয়্যারহাউজ লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করার অর্থাৎ বিদ্যমান লাইসেন্সপ্রাপ্ত সুবিধার অংশ হিসেবে বিবেচনার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স (বিটিটিএলএমইএ), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ), লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএ), বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) এবং বাংলাদেশ শিপ বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত নিট, ওভেন, ডাইং, প্রিন্টিং, টাওয়েল, লিনেন, হোম টেক্সটাইল, লেদার, ফুটওয়্যার, ট্যানারি, শিপ বিল্ডার্স খাতের প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব নির্বিশেষে মূল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অব্যাহত বন্ড সুবিধা প্রদান করা হবে। এ ব্যবস্থা বন্ড সুবিধাকে অনেক প্রসারিত করল, পূর্বে বিভিন্ন ইএসএআরওর মাধ্যমে এগুলো দেয়া হতো, এগুলো লাইসেন্সিং বিধিতে সংযুক্ত হওয়ায় রফতানিকারকদের জন্য তা সহায়ক হবে। 

এ ওয়্যারহাউজ বিধিমালা অনুসারে একটি প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ তিনটি কারখানার জন্য এ সুবিধা পাবে, যেগুলো একই জাতীয় কারখানা হতে হবে। তবে এ কারখানাগুলোর জন্য সম্পূর্ণ পৃথক হিসাব খাতা, রেজিস্টার ও দলিলাদি সংরক্ষণে আনুষ্ঠানিকতা ও পদ্ধতি মেনে চলবে। 

এছাড়া নতুন বিধিতে অনলাইন লাইসেন্স আবেদনের সুযোগ দেয়া হয়েছে, যা সবার জন্য বন্ড সুবিধাকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। এর বাস্তবায়ন বিশেষভাবে দরকার। অটোমেশনের কথা দীর্ঘদিন থেকে বলা হলেও বিভিন্ন কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে আংশিক রফতানিকারকদের জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা রফতানিকারকদের রফতানি বহুমুখীকরণে সহায়ক হতে পারে। এ ব্যাপারেও অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই, এতে অপচয়ের সুযোগ হ্রাস পাবে এবং দেশীয় শিল্পের জন্য আশঙ্কার কারণ হবে না। 

ফেরদাউস আরা বেগম: সিইও, বিল্ড—একটি পাবলিক প্রাইভেট ডায়ালগ প্লাটফর্ম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন