ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক

কালো টাকার উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

ঘুস, দুর্নীতি, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, কালোবাজারি, মাদক ব্যবসা, আমদানি-রফতানিতে জালিয়াতি, ব্যাংক ঋণ আত্মসাৎ ও বৈধ আয়ে কর ফাঁকিসহ বেআইনি কাজের মাধ্যমে আহরিত অর্থই হচ্ছে কালো বা অপ্রদর্শিত অর্থ। কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় দেশের বাইরে পাচার হওয়ার পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক ও অনিয়ন্ত্রিত লেনদেনেও ব্যবহার হয়ে থাকে। বৈধতা না থাকায় মূলধারার বাইরে চলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা বিনিয়োগে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে সরকারও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব পাচ্ছে না। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে সরকার কালো টাকাকে মূলধারায় নিয়ে আসার সুযোগ দিলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া মেলেনি। এ অর্থের লেনদেন বা কর্মকাণ্ড দেশের প্রচলিত নিয়মকানুন অনুযায়ী বিধিসম্মত নয়। এ অর্থের লেনদেন অনিয়ন্ত্রিত, করারোপিত নয় এবং এগুলো পরিমাপ করা হয় না, কারণ ওইসব লেনদেন নথিভুক্ত নয়। ফলে প্লট, ফ্ল্যাটসহ স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, স্বর্ণ চোরাচালান ও অবৈধ হুন্ডি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে এ অর্থ। এটি দেশের অর্থনীতিতে শুধু আয়বৈষম্যই তৈরি করে না, বরং দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতাকেও উৎসাহিত করে। কর প্রদানের সময় এ অর্থকে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটি হালকা করে দেখা সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এ অর্থের উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করাসহ সব সুযোগ বন্ধ করতে হবে। 

আবাসন খাতে বিশেষ করে প্লট-ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ে এ কালো টাকার একটি বড় অংশ ব্যবহার হয়ে থাকে। সহজেই অবৈধ অর্থের মালিকরা যে দামে প্লট-ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় করেন তার চেয়ে অনেক কম দামে সেগুলো নিবন্ধন করে থাকে। বৈধ কাগজপত্রের মাধ্যমেই কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থের অংশটি সহজেই গোপন রাখতে পারছে তারা। কিন্তু রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। কয়েক বছর ধরেই কালো টাকার প্রভাবে জমি, প্লট-ফ্ল্যাটের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। তবে কর ফাঁকি রোধ করতে এসব ভূসম্পত্তির নিবন্ধন মূল্যকে বাজারমূল্যের কাছাকাছি পর্যায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন। গত ২৫ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করনীতি উইং থেকে এ-সংক্রান্ত আয়কর নির্দেশিকা ২০২৪-২৫ প্রকাশ করা হয়েছে। এ নির্দেশিকায় দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণের নকশা দাখিলকালে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। এ উদ্যোগ যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় তাহলে আবাসন খাতে কালো টাকার প্রভাব কমতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করলেই হবে না, বরং এটি কার্যকর করতে তদারকি বাড়াতে হবে। এ অর্থের লালন করার সংস্কৃতি থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে সহজেই দেশের মানুষের মুক্তি মিলবে না। 

উপমহাদেশে ভূমি নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সূচনা হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভূমি নিবন্ধনের জন্য সর্বভারতীয় আইন হিসেবে ১৯০৮ সালের ১৬ নম্বর আইন জারি করা হয়, যা বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন আইন নামে পরিচিত। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরও সংবিধানের ১৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে আইনটি বহাল রাখা হয়। রেজিস্ট্রেশন বিভাগের সুদীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও জনগুরুত্বসম্পন্ন বিভাগটিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুগোপযোগী করা হয়নি। বিগত সরকারের আমলে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নেয়া হলে নানা ভুলভ্রান্তিতে জনগণ স্বচ্ছ, হয়রানিমুক্ত ও মানসম্পন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজধানীর অন্য এলাকার চেয়ে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমন্ডিতে প্লট-ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে অনেক বেশি দামে। এসব এলাকায় দেশের মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী ও সরকারি প্রভাবশালী আমলাদের বসবাস। সৎভাবে জীবনযাপন করলে বা দেশে যে বেতন কাঠামো তাতে আমলা কিংবা অন্যদের পক্ষে এসব এলাকায় একটি প্লট-ফ্ল্যাট কেনাই কঠিন। যদিও তারা এসব এলাকায় একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট নগদে ক্রয় করছেন—এমন খবর প্রতিনিয়তই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে তাদের আয়ের উৎস ও উপার্জিত অর্থ নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন উঠছে। 

অন্যান্য বছরের বাজেটের মতো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্থাবর সম্পত্তি যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে কালো বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয় বিগত সরকার। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল ঘোষণার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২ সেপ্টেম্বর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট, সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিটের ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বাজেটের সময় ঘোষিত এলাকাভেদে স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমিতে প্রতি বর্গমিটারের বিপরীতে বিভিন্ন মৌজা অনুযায়ী বিভিন্ন দর পরিশোধের ভিত্তিতে অপ্রদর্শিত (কালো) অর্থ প্রদর্শিত (সাদা) করার সুযোগ বহাল রয়ে গেছে এখনো। অন্যদিকে বৈধ আয়ে সরকার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ করারোপ করে। এ ধরনের বিধান বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবে না’। এটা স্পষ্টত দ্বিমুখী নীতি। এ অন্যায্য আইনের মাধ্যমে মূলত অসৎ করদাতাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আর সৎ করদাতাদের প্রতি করা হচ্ছে অবিচার। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবশ্যই কালো টাকা সমাজের বা সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অনৈতিকতা ও অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায়-ন্যায্যতা নীতিনির্ভরতায় বিপুল ব্যর্থতার প্রতিফল। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক নজির থেকে দেখা যায়, তুলনামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়ার পর হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পেরেছে। এসব দেশ প্রথম পর্বে কালো টাকাকে প্রযত্ন দিতে সাদা করাকে গুরুত্ব দিত। পরবর্তী সময়ে শক্ত হাতে কালো টাকা সৃষ্টির উৎস বন্ধ করার রাষ্ট্রীয় প্রতিবিধান জোরদারের ফলে সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতিসঞ্চার হয়েছে। যেমন সুহার্তোর ১৯৬৫-৯৮ সালের ৩৩ বছরের শাসনকে ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে ‘লুটপাটের শাসনামল’ হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু গত দুই দশকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হওয়ায় সেখানে এখন অর্থবহ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে।

অর্থনীতিতে কালো টাকা ফিরিয়ে আনার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জরিমানা ও নিয়মিত কর আদায়। এরপর উৎপাদনশীল খাতে সেই অর্থ বিনিয়োগ করা। নানা আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরীক্ষা-পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কালো টাকা অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে অর্থনীতি বরং কালো টাকামুখী হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়েই চলেছে। এটি গণতন্ত্রসহ সব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সংক্রমণ ও দখল করার পথে ধাবমান। কেননা কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ অন্যায্য বোধকে প্রশ্রয় দেয়। সীমিত আকারে ও স্বল্প সময়ের জন্য এ সুযোগ অর্থনীতির জন্য সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাচার হওয়া অর্থ অর্থনীতিতে ফেরত আসার পরিবর্তে পাচারের পরিমাণ ক্রমেই বেড়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গত বছরের মে মাসে বিকল্প বাজেট প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) পরিসংখ্যানমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-১৫ সময়কালে অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অংকে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। 

রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত কালো টাকার উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। অবৈধভাবে অর্জিত বা আয়ের জ্ঞাত সূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যেকোনো অর্থবিত্তকে কালো টাকা অভিহিত করার যে আইনি অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, সেটাই সাংবিধানিকভাবে বেশি যৌক্তিক। এর আলোকে দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ বেড়াজাল থেকে আইনের আওতায় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ঘুসখোর আমলা এবং অতিমুনাফাবাজ, চোরাকারবারি, ব্যাংক লুটপাটকারী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অপরাধের শাস্তি বিধান জরুরি। তাহলে সমাজে ও অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক বার্তা যাবে। জরিমানা ছাড়া, অত্যন্ত হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুযোগ এবং ‘অর্থের উৎস নিয়ে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবেন না’—এ ধরনের জাতীয় বিধান বলবৎ থাকায় দেশের অর্থনীতি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। কালো টাকা লালন থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের সহজেই মুক্তি মিলবে না। কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা না করে সর্বতোভাবে বন্ধ করতে হবে। 

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পতন হয়েছে। দেশের দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দাবি উঠেছে, বৈষম্য নিরসন, রাষ্ট্র সংস্কার ও ন্যায্যতা নিশ্চিতের। তাছাড়া কালো বা অপ্রদর্শিত অর্থকে সাদা করার সুযোগ দেয়া সংবিধান পরিপন্থী। তাই কালো টাকার উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বন্ধ করতে হবে। এখন যেহেতু ছাত্র-জনতার সরকার, সেহেতু সংবিধান পরিপন্থী ও অন্যায্য সব সুবিধা বন্ধ করতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন