আলোকপাত

বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণার প্রায় ১০ বছর: প্রাণহানি কি কমানো গেল?

আশরাফ দেওয়ান

ছবি : বণিক বার্তা

দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড় নিয়মিত ঘটনা হলেও বজ্রপাতের সংখ্যা অতীতে কম ছিল, এমনটা নয়। যেহেতু ঝড়ঝঞ্ঝার সঙ্গে বজ্রপাত সংঘটনের সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে আর প্রাক-মৌসুমি ও মৌসুমি সময়কালে বাংলাদেশে প্রচুর ঝড়ঝঞ্ঝা হয় সেহেতু বজ্রপাত অতীতেও হয়েছে সেটা নিশ্চিত। অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন, বজ্রপাত কি সাম্প্রতিক কালে মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে? বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন কি বজ্রপাত বৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে? দুটো প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়া কঠিন, কিন্তু গবেষণা বলছে বাংলাদেশে বজ্রপাতের সংখ্যা অল্পই বেড়েছে, অন্তত ২০১৪-২১ পর্যন্ত উপগ্রহ ও  গ্রাউন্ড-বেজড মিনিটপ্রতি উপাত্ত বিশ্লেষণে আমরা নিশ্চিত যে দেশে বজ্রপাত বলার মতো বাড়েনি অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা যাকে বলি পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ঊর্ধ্বগতি। অবধারিতভাবে যে প্রশ্ন সামনে আসে তা হলো মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে কেন? এর উত্তর আমি নিচে দেব। তার আগে চলুন দেখি জলবায়ু পরিবর্তনের কী ভূমিকা? যেহেতু শুষ্ক আবহাওয়া বায়ুমণ্ডলে পানি বেশি ধরে রাখতে পারবে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দরুন শুষ্কতা বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাপীও বজ্রপাত বাড়বে বলে ধারণা। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বজ্রপাত সম্পর্কিত প্রচুর গবেষণা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। মোটা দাগে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও দেশভিত্তিক গবেষণাগুলোর উপসংহার হলো—প্রথমত, উষ্ণায়নের ফলে বজ্রপাত সমানুপাত হারে বাড়বে না। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পর বজ্রপাতের সংঘটন স্তিমিত হয়ে পড়ে। যেমন গত বছর এপ্রিল-মে পর্যন্ত বাংলাদেশসহ সারা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মাসাধিক সময় ধরে দাবদাহ বিরাজমান ছিল, কিন্তু ওই সময়ে বজ্রপাত কয়টা হয়েছে বা কতজনের মৃত্যু হয়েছে? মনে করতে পারেন কি? আমাদের প্রতি মিনিটের গ্রাউন্ড বেজড উপাত্ত বলছে দাবদাহের সময় বাংলাদেশে বজ্রপাতের সংখ্যা ছিল নেহাতই কম। অর্থাৎ ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বজ্রপাত বেশি হলে ৫০ ডিগ্রিতে তা কমে আসবে। সুতরাং বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বজ্রপাত বাড়বে বা বাড়ছে এমন ধারণার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দুর্বল। দ্বিতীয়ত, বজ্রপাত স্থানীয় (localized) একটা বায়ুমণ্ডলীয় গোলযোগ। মানে বজ্রপাত সংঘটনের প্রয়োজনীয় উপকরণ (যেমন ভূমি থেকে মেঘের উচ্চতা, বাতাসে  আর্দ্রতার পরিমাণ, অ্যান্টিসাইক্লোনিক অবস্থা ইত্যাদি) থাকলেই কেবল বজ্রপাত বা বজ্রঝড় হতে পারে। আবার সব মেঘে বজ্রপাত হয় না। কখনো কখনো পরিষ্কার আকাশ থাকলেও বজ্রপাত হতে পারে যেটা খুবই অস্বাভাবিক। এ অস্বাভাবিকতাকে ইংরেজিতে  ‘bolt from the blue’ বলে এবং আবহাওয়ার এমন অবস্থাকে আমরা দৈনন্দিন অভিব্যক্তিতে প্রায়ই ব্যবহার করি।

চলুন দেখি মৃত্যুর পরিসংখ্যান। এ বিষয়ে তথ্যের অস্পষ্টতা দেশের রাজনৈতিক গোঁজামিলের মতো। বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ১৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে, যার বেশির ভাগই গরিব কৃষক। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে গবেষণায় দেখেছি, মোবাইল ও ইন্টারনেটের কারণে বর্তমানে বজ্রপাতে হতাহতের খবর বেশি যা ২০০০  সালের আগে ছিল খুবই কম। তাছাড়া   ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে সরকার জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করলে এবং মৃত্যুপ্রতি সরকারি সাহায্যের আশ্বাসও হতাহতের রিপোর্টিংকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। কেননা অতীতে বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তির তথ্য দেশে লুকানো হতো। আমরা যদি ৪ হাজার ১৭  প্রাণহানিকে ১৫ দিয়ে ভাগ করি তবে বছরপ্রতি মারা যাচ্ছে ২৬৮ জন। ভয়ংকর তাই না! তবে এটা গড় সংখ্যা। সত্য হচ্ছে, সব বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ২৬৮ হয় না। কোনো বছরে তিন শতাধিক বা দুইশর কম। যা-ই হোক, কেন মৃত্যু বা রিপোর্টিং বাড়ছে তার পরোক্ষ ব্যাখ্যা ওপরে বলেছি আর প্রত্যক্ষ ব্যাখ্যাটা হলো, গত ৩০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের ভূমি ব্যবহারের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ফলে ভূপৃষ্ঠীয় তাপীয় ভারসাম্যের (surface energy balance) পরিবর্তনে ভূমি-বায়ুমণ্ডল মিথস্ক্রিয়ার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে স্থানীয় ক্ষেত্রে। এছাড়া দেশের নদ-নদী, জলাশয়, ডোবা-নালা, প্রাক-মৌসুমি কৃষি সেচ বজ্রপাতের স্থানিক-কালিক বণ্টনকে প্রভাবিত করছে। কীভাবে? বাতাসে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা সরবরাহের মাধ্যমে। আমাদের গবেষণা অন্তত তা-ই বলে। সুতরাং ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনে গাছপালা নিধনে হতাহতের ঝুঁকি বাড়ছে। মৃত্যু বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ কারণের অন্যতম আরেকটা হচ্ছে মানুষের এক্সপোজার বহুগুণে বেড়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে বজ্রপাত সম্পর্কিত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। যেমন বজ্রপাতের সময় পানির সংস্পর্শে থাকলে বা বড় গাছের নিচে আশ্রয় নিলে বা ধাতব পদার্থের সংস্পর্শে থাকলে মৃত্যুঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়ে অথচ এ ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান বা সচেতনতা খুবই কম। 

প্রায় ১০ বছর হতে চলেছে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণার। কিন্তু মৃত্যু কি কমেছে? গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে বজ্রপাত থেকে মৃত্যু হ্রাসে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, এর মধ্যে আবহাওয়া বিভাগের ৬২ কোটি টাকার প্রকল্প কোনো আলোর মুখই দেখেনি। এখনো ১ হাজার ৭২১  কোটি টাকা ছাড়ে দেনদরবার চলছে বলে খবর রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণের করের টাকায় মৃত্যু তো কমছেই না, বরং ঝুঁকি বাড়ছে। যেহেতু আমাদের নীতিনির্ধারকরা বড় প্রকল্পে বেশি আগ্রহী সেহেতু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার তোয়াক্কা না করে প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ করে শুধু সম্পদের অপচয় করছে। ২০২১  সালের ১৩  অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোয় অভিমত প্রকাশ করেছিলাম যে ৫০-১০০ কোটি টাকা খরচ করলে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব, কিন্তু কে শোনে কার কথা! যা-ই হোক, বজ্রপাতের মতো স্থানীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনার বিকল্প কী হতে পারে সেটা হয়তো আমাদের নীতিনির্ধারকরা ধর্তব্যে নেন না। মৃত্যু যেহেতু গরিবের আর করের টাকাও তাদের, সুতরাং অর্থের যাচ্ছেতাই ব্যবহারে আর যা-ই হোক ধনীরা কিছুটা তো লাভবান হচ্ছেন। ব্যাপারটা এমন যে মরার জন্যই গরিবের জন্ম। অথচ শহরবাসী কি কখনো ভেবে দেখেছেন—কৃষকরা ফসল না ফলালে আপনি কী খেয়ে বাঁচতেন, মৎস্যজীবী মাছ না ধরলে ইলিশ কোত্থেকে আসত?    

নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে শুরু হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন কপ২৯। আসন্ন কপে আলোচ্যসূচির অন্যতম একটি হবে জলবায়ু অর্থায়ন। ধনী দেশগুলোর অতিরিক্ত গ্রিনহাউজ নির্গমনে পরিবর্তিত জলবায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া যায় সে বিষয়ে একটা সমষ্টিগত অর্থায়ন মডেল প্রস্তাব হতে পারে। এরই মধ্যে ধনী দেশগুলোর অনেকেই বলছে নির্ভরযোগ্য ও সুস্পষ্ট তথ্য ব্যতিরেকে জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঢালাও অর্থছাড় নয়। অর্থাৎ ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ গোছের উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণ আদায় আকাশকুসুম কল্পনা হতে পারে, অন্তত পরিবর্তিত বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। সুতরাং দেশের গোঁজামিল রাজনীতির মতো জলবায়ুর ক্ষতি সম্পর্কিত ‘লস ও ড্যামেজ’ মডেল অনুষ্ঠিতব্য কপে প্রদর্শিত হলে সেটা হবে আত্মঘাতী। সঠিক, সংখ্যাতাত্ত্বিক ও গাণিতিক উপাত্তই হতে পারে ধনী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের জয়ের একমাত্র হাতিয়ার। 

জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন বায়ুমণ্ডলীয় যেকোনো দুর্যোগের পূর্বাভাস বিশ্বব্যাপী যেমন দুরূহ হয়ে উঠছে তেমনি বাড়ছে তাদের তীব্রতাও। আর জলবায়ুর এলোমেলো অবস্থার কারণে মানুষের জীবনজীবিকাও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, বাড়ছে প্রাণহানি ও ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপক সম্পদের। যেহেতু দেশে বজ্রপাতের ঋতু ও এলাকাভিত্তিক তারতম্য রয়েছে, সুচারু পরিকল্পনা ব্যতীত বজ্রপাত কেন কোনো দুর্যোগই মোকাবেলা সম্ভব নয়। আর তাই প্রয়োজন জলবায়ু স্বাক্ষর জনগোষ্ঠী ও সর্বোপরি দূরদর্শী নীতিনির্ধারক। অযথা অর্থ অপচয় না করে প্রয়োজন সচেতনতা তৈরি ও করণীয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা।

আশরাফ দেওয়ান: গবেষণা পরিচালক, স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্লানেটারি সায়েন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন