পূর্বাচলে সংরক্ষিত আসনে বরাদ্দ প্লটের তালিকা নেই রাজউকের কাছে!

আল ফাতাহ মামুন

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

নানা সময় সরকার বিশেষ ব্যক্তিদের পূর্বাচলে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। পূর্বাচলে মোট প্লটের সংখ্যা ২৬ হাজার ২১৩। এর মধ্যে সংরক্ষিত প্লটের সংখ্যা ১০ শতাংশ বা ২ হাজার ৬২১টি। রাজউক সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত পূর্বাচলে সংরক্ষিত ১০০-এর কম খালি প্লট রয়েছে। তবে সংরক্ষিত কোটায় কত প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে কিংবা বাকি আছে কতটি—এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য রাজউকের কাছে নেই। কারা সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন সে তালিকাও নেই সংস্থাটির কাছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরাদ্দপ্রাপ্তদের সুনির্দিষ্ট তথ্য না রেখে অনিয়মের চূড়ান্ত উদাহরণ তৈরি করেছে রাজউক। প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের তথ্য রাখা সংস্থাটির মৌলিক কাজ হওয়া সত্ত্বেও এখানে গাফিলতির পেছনে যারা জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিও তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

একটি আধুনিক শহর করার জন্য ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে ৬ হাজার ২৭৭ দশমিক ৩৬ একর জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের কাজ। পুরো প্রকল্পকে ৩০টির বেশি সেক্টরে ভাগ করে সেখানে ২৬ হাজার ২১৩টি আবাসিক প্লট করা হয়েছে। এর ব্যয় ৭ হাজার ৭৮২ কোটি ১৪ লাখ টাকা ধরা হলেও সর্বশেষ সংশোধন অনুযায়ী তা ৬ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা করা হয়।

পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্প তৈরির পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীবাসীর আবাসন সমস্যার সমাধান। কিন্তু শুরু থেকে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক অনেক। প্রকল্পটির কাজ শুরুর কথা ছিল ১৯৯৫ সালে। যদিও তা অনুমোদন পেতে লেগে যায় ২০০৫ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কৃষিজমি, বিল, নালা ভরাট করা হয়। পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখেও পরিকল্পিত নগরায়ণের কথা বলে অনড় থাকে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। যদিও এখন পর্যন্ত সেখানে তেমন কোনো আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি।

আবাসন সমস্যার সমাধান না হলেও পূর্বাচল ছিল গত সরকারের ঘনিষ্ঠদের জন্য উপঢৌকনস্বরূপ। সরকার যাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত তাকেই পূর্বাচলে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দিয়ে দিত। সর্বশেষ শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিকে অভিনয় করার প্রাপ্তি হিসেবে অভিনেতা আরিফিন শুভকে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ দেয় সরকার। তবে এভাবে কতজনকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই রাজউকের কাছে। 

রাজউকের সম্পত্তি বিভাগের একাধিক সূত্র বণিক বার্তাকে বলেছে, পূর্বাচলে কারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছে, কীভাবে পেয়েছে এ নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকেও তথ্য চাওয়া হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু রাজউকে এ তথ্য না থাকায় তা দেয়া যায়নি। এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে একটি তালিকা করার। সে কাজ এখনো শুরু হয়নি।

রাজউক সূত্র জানিয়েছে, সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে রাজউকের বোর্ড মিটিংয়ে। এখন বোর্ড মিটিংয়ের নথি ঘেঁটে এ তালিকা করতে হবে। এজন্য সময় লাগবে।

বরাদ্দপ্রাপ্তদের তালিকা না থাকা রাজউকের চরম দুর্বলতা বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রাজউকের মতো সংস্থার মৌলিক কাজ তার কাছ থেকে কারা কত প্লট বরাদ্দ পেয়েছে সেটার তালিকা হালনাগাদ রাখা। কিন্তু রাজউকের কাছে কোনো তালিকাই নেই, এটা দায়িত্ব অবহেলার চূড়ান্ত রূপ। রাজউক বোর্ড মিটিংয়ে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দিয়েছে, এ থেকে বোঝা যায় সংস্থাটির ওপর আমলাতন্ত্রের কত প্রভাব ছিল। এখন সময় এসেছে রাজউকের সব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সংস্কার করা।’

রাজউকের প্লট ডেভেলপমেন্ট ও বরাদ্দ প্রক্রিয়া পুরোটাই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতিসহায়ক বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজউকের আবাসন কার্যক্রমে আমরা এক ধরনের বৈষম্য দেখতে পাই। বরাদ্দের ক্ষেত্রে যাদের প্রাধান্য দেয়া হয় তারা কোনো না কোনোভাবে দলীয় রাজনীতি বা শাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ফলে ক্ষমতাপ্রবাহের একটা নমুনা তৈরি হয়। রাজউকের সম্পদ মানেই তো রাষ্ট্রের সম্পদ। সংবিধান অনুযায়ী এগুলোর বণ্টন বৈষম্যহীন হওয়ার কথা। সেটি না হয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ দিয়ে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকভাবে আরো বৈষম্য তৈরি করেছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন