সময়ের ভাবনা

‘‌প্রত্যয়’ স্কিম: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আর্থিক বঞ্চনার রূপকল্প

ড. মো. মমিন উদ্দিন

ছবি : বণিক বার্তা

গত ১৩ মার্চ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ অন্যান্য স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে ‘‌প্রত্যয়’ নামক একটি পেনশন স্কিম ঘোষণা করে। তখন থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যুগপৎভাবে ‘প্রত্যয়’ থেকে তাদের অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে শান্তিপূর্ণভাবে যথাযথ যুক্তি দেখিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। তিন মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে বিবৃতি দিয়ে, সিগনেচার ক্যাম্পেইন করে, মানববন্ধন করে ১ ঘণ্টা-২ ঘণ্টা-অর্ধদিবস-পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেছে। দাবি পূরণ তো দূরের কথা, শিক্ষকদের এ দাবিকে সরকারের কোনো পক্ষ গুরুত্বই দেয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন ‘‌প্রত্যয়’ থেকে তাদের অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবি করছেন? ‘‌প্রত্যয়’ বিধি অনুযায়ী অবসরের পর একজন চাকরিজীবী এককালীন কোনো আনুতোষিক পাবে না, মাসে মাসে একটি নির্দিষ্ট অংকের পেনশন পাবেন এবং এই পেনশনের জন্য তাকে চাকরি জীবনের শুরু থেকে তার মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা ৫ হাজার (যেটা কম) টাকা পেনশন ফান্ডে জমা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বর্তমান প্রচলিত নিয়মে অবসরে গেলে ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আনুতোষিক, প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমাকৃত টাকা ১৩ শতাংশ হারে লাভসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকা এবং ১৮ মাসের অর্জিত ছুটি নগদায়ন করে ১৪ লাখ ৪ হাজার টাকা অবসরের সময় এককালীন পেয়ে থাকেন। এছাড়া বার্ষিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ মাসে মাসে কমপক্ষে ৩৬ হাজার ৬৫৫ টাকা পেনশন, বছরে কমপক্ষে ৭৩ হাজার ৩১০ টাকা উৎসব ভাতা, বছরে কমপক্ষে ৭ হাজার ২০ টাকা বৈশাখী ভাতা এবং প্রতি মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন। একজন অবসরভোগী আজীবন এবং তার মৃত্যুর পর তার নমিনি আজীবন (তার কোনো প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে সে আজীবন) এ মাসিক পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকে। এসব পেনশন সুবিধার জন্য চাকরিকালীন বেতন থেকে কোনো টাকা কর্তন করা হয় না, শুধু প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার জন্য চাকরিকালীন মূল বেতনের ১০ শতাংশ টাকা কর্তন করা হয়।

‘‌প্রত্যয়’ পেনশন স্কিমে ওপর উল্লেখিত সব পেনশন সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। ‘‌প্রত্যয়’ বিধি অনুযায়ী একজন শিক্ষক ৩০ বছর চাকরি করে অবসর গ্রহণ করলে প্রতি মাসে ফিক্সড (কোনো বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট নেই) ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ (১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০) টাকা পেনশন পাবেন। এককালীন কোনো টাকা পাবেন না। এমনকি ঈদ বোনাস ও বৈশাখী ভাতাও নেই। আরো ভয়ংকর কথা যে, পেনশনভোগীর মৃত্যুর পরে তার নমিনি পেনশনারের ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাবেন। অর্থাৎ পেনশনভোগী ৭৪ বছর বয়সে মারা গেলে তার নমিনি মাত্র এক বছর পেনশন পাবেন।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা হলো: অবসরভোগী এককালীন কোনো আনুতোষিক না পেলেও আর্থিকভারে তার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং অনেক বেশি লাভ হবে। পেনশন কর্তৃপক্ষের এ ব্যাখ্যা শুধু ভুলই নয়, অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর ও প্রতারণামূলক। পেনশন কর্তৃপক্ষের একজন সদস্য টকশোতে হিসাব করে দেখালেন যে, চলমান পেনশন নিয়মে একজন শিক্ষক ৩০ বছর চাকরি করে অবসরে গেলে ৩৫ হাজার ১০০ টাকা পেনশন পান, অন্যদিকে ‘প্রত্য়য়’ স্কিমে এরূপ একজন অবসরভোগী মাসে পাবেন ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা। ‍সুতরাং এককালীন কোনো টাকা না পেলেও তিনি অনেক বেশি লাভবান হবেন। পেনশন কর্তৃপক্ষের এ সদস্য ২০২৪ ও ২০৫৪ সালকে একাকার করে ফেলেছেন এবং তিনি তার এ ভুল অংকটি ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করছেন। ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা ২০২৪ সালে পাবেন না, এটা কার্যকর হবে ২০৫৪ সালের ১ জুলাই থেকে যারা অবসরে যাবেন তাদের ক্ষেত্রে। যেহেতু প্রত্যয়ে কোনো বার্ষিক বৃদ্ধি নেই তাই একজন অবসরভোগী ২০৫৪ সালে যা পাবেন পরবর্তী সময়ে ওই একই টাকা পাবেন। ২০৫৪ বা ২০৬০ সালে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে এক মাস ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হবে। এখন যে বাসার ভাড়া ৪০ হাজার টাকা ২০৬০ সালে ওই বাসার ভাড়া নিশ্চয় ৪০ হাজার টাকা থাকবে না। 

বর্তমান ব্যবস্থায় ৩০ বছর চাকরির পর একজন অধ্যাপক অবসরভোগী বার্ষিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ কমপক্ষে ৩৬ হাজার ৮৫৫ টাকা পেনশন পান। ২০৫৪ বা ২০৬০ ‍সালে বর্তমান ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপক অবসরভোগী নিশ্চয় ৩৬ হাজার ৮৫৫ টাকা পেনশন পাবেন না। ২০৫৪ সাল পর্যন্ত সরকার যদি আর কোনো পে-স্কেল ঘোষণা নাও করে তাহলেও বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট সমন্বয় করে ২০৫৪ সালে একজন অধ্যাপক পর্যায়ের অবসরভোগীর শুধু মাসিক পেনশন হবে ১ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ টাকা। আর এককালীন পাবেন ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর জন্য পেনশনভোগীর বেতন থেকে কোনো টাকা কর্তন করা হবে না। অন্যদিকে ‘‌প্রত্যয়’ স্কিমে এরূপ একজন অবসরভোগী পাবেন মাত্র ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা, যার জন্য তার বেতন থেকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা কর্তন করা হবে। এককালীন কোনো আনুতোষিক তো তিনি পাবেনই না। সরকার যদি পূর্বের মতো পে-স্কেল ঘোষণা করে তাহলে বর্তমান পেনশন নিয়মে ২০৫৪ সালে একজন অধ্যাপক অবসরভোগীর এককালীন আনুতোষিক ও মাসিক পেনশন ওপরে উল্লেখিত অংকের প্রায় দ্বিগুণ হবে। যেমন ১৯৭৩ সালে প্রথম গ্রেডের স্কেল ছিল ২ হাজার টাকা, যা ৪২ বছর পর ২০১৫ সালে হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা। প্রথম থেকে অষ্টম পে-স্কেল পর্যন্ত সময় এবং বৃদ্ধির হার বিবেচনায় গড় বৃদ্ধির হার প্রায় ৭ গুণ। পে-স্কেল সরকারকে অবশ্যই ঘোষণা করতে হবে এবং আর্থিক চাপে পূর্বের চেয়ে কম হারেও যদি বৃদ্ধি করে—২০৫৪ সাল পর্যন্ত গড় বৃদ্ধি পাঁচগুণও যদি হয়—তবুও ওই সময় অবসরকালীন স্কেল হবে ৭৮০০০×৫=৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে এককালীন আনুতোষিক হবে ৪ কোটি ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, এককালীন ছুটি নগদায়ন হবে ৭০ লাখ ২০ হাজার টাকা আর মাসিক পেনশন হবে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা, বার্ষিক উৎসব ভাতা হবে ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা, বৈশাখী ভাতা হবে ৩৫ হাজার ১০০ টাকা। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকেও ৩০ লাখের বেশি টাকা পাবেন। 

শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ একটি প্রেস রিলিজ দিয়ে বলেছে, ‘‌প্রত্যয়’ স্কিমে অর্জিত ছুটি নগদায়নের সুযোগ থাকবে এবং শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ বছর রাখা হবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডও রাখা হবে। তবে প্রভিডেন্ট ফান্ড কীভাবে রাখা হবে তা বোধগম্য নয়। বর্তমান নিয়মে প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ টাকা কর্তন করা হয়। তাহলে কি ১০ শতাংশ টাকা পেনশনের জন্য এবং ১০ শতাংশ টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য কর্তন করা হবে? প্রভাষক পদের শিক্ষকের বেতন থেকে ২০ শতাংশ (৪ হাজার ৪০০) টাকা কর্তন করলে ওই শিক্ষক কি জল-হাওয়া খেয়ে থাকবে? 

‘প্রত্যয়’ স্কিমের সবচেয়ে অমানবিক এবং নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত প্রকাশ হলো নমিনির পেনশনের সুযোগ বন্ধ করা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে একজন শিক্ষককে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। বেতনের ওপর যাদের নির্ভর করতে হয় তাদের সারা জীবন ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। অবসর গ্রহণের ১৫ বছর পর একজন পুরুষ অবসরভোগীর মৃত্যু হলে তার বৃদ্ধ স্ত্রীকে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না। প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে কী অমানবিক অবস্থা তৈরি হবে তা সহজে অনুমেয়। 

সর্বোপরি ‘‌প্রত্যয়’ পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রতি কর্তৃপক্ষের একটি পদ্ধতিগত উদাসীনতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অমর্যাদা প্রদর্শন। এমন আচরণ বজায় রাখলে ভবিষ্যতে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। এতে উচ্চ শিক্ষা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

ড. মো. মমিন উদ্দিন: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন