আলোকপাত

কালো টাকার গন্তব্যস্থল ‘সভ্য-গণতান্ত্রিক-উন্নত’ দেশকে কেন কেউ প্রশ্ন করছে না

ড. আর এম দেবনাথ

ছবি : বণিক বার্তা

অনেক জিনিস আজকাল বুঝি না। যেমন বুঝি না ‘‌কালো টাকার’ বিদেশী সম্পর্ক। এ কথা পরিষ্কার আমরা ‘‌কালো টাকাকে’ অভিশাপ মনে করি। অথচ উন্নত গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশ বলে পরিচিত দেশগুলো আমাদের ‘‌কালো টাকাকে’ আশীর্বাদ মনে করে। আমরা ‘‌কালো টাকার’ মালিকদের শাস্তি চাই, তাদের বিচার চাই আর তারা তাদের ‘জামাই আদর’ করে। আমরা পাচারকৃত ‘কালো টাকা’ উদ্ধার করতে চাই আর তারা ওই টাকা তাদের দেশে বিনিয়োগ করতে দেয়, ঘরবাড়ি কিনতে দেয়। আমরা তাদের ধরতে চাই, আর তারা ‘‌কালো টাকার’ মালিকদের ওই টাকার বদৌলতে নাগরিকত্ব দেয়, গোল্ডেন, সিলভার ভিসা দেয়, স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেয়। পরিস্থিতি এমন যে ওইসব দেশে দুনিয়ার খুনি, সন্ত্রাসী পর্যন্ত আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সেসব দেশে। এই তো সেদিন আমাদের একজন সংসদ সদস্য খুন হয়েছেন। খুনের মূল পরিকল্পনাকারী নিরাপদ আশ্রয়ে গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশে উড়ে চলে গেছে। পৃথিবীর বহু দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ আছে। তাদের অনেকেই মানবাধিকারের অজুহাতে সেসব দেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। এসব দেখে-শুনে মনে প্রশ্ন জাগে এটা কী কারণে হচ্ছে? আমরা কি তাহলে গণতান্ত্রিক, সভ্য দেশ নই যে কারণে আমাদের দেশে ‘‌কালো টাকার’ স্থান নেই, ‘‌কালো টাকার’ মালিকদের স্থান নেই। বুঝি না, কিছুই বুঝি না। এ প্রশ্নের উত্তর সরকারের কাছে চেয়ে লাভ নেই। কারণ সরকার ‘কালো টাকা’ ‘সাদা’ করার সুযোগ দিয়েছে। দলমত নির্বিশেষে এ পর্যন্ত আমাদের সব সরকার এ ‘পবিত্র’ কাজটি করেছে। তাহলে কার কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞান নিতে পারি? কে আমাদের উন্নত বিশ্বের এ ধরনের কাজের ব্যাখ্যা দিতে পারে? শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন‌ ব্যাংক, জাতিসংঘ ইত্যাদি সংস্থাও ‘‌কালো টাকার’ বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেয় না। এই যে আমাদের ‘‌ত্রাণকর্তা’ আইএমএফ এখন আমাদের দেশ চড়ে বেড়াচ্ছে। কিছু টাকা লোন দেবে তারা। এজন্য কত শর্ত। এ করতে হবে ওই করতে হবে। উত্তর দিকে যাওয়া যাবে না, দক্ষিণ দিকে যেতে হবে। বিদ্যুতের দাম বছরে চারবার বাড়াতে হবে—কিন্তু তোমাদের মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। ভর্তুকি সব তুলে দিতে হবে কিন্তু জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। যতসব স্ববিরোধী শর্ত ও কথা। ডলারের দাম বাড়াতে হবে কিন্তু জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। গরিবের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। আবার বলে তোমাদের রাজস্ব বাড়াতে হবে। আচ্ছা রাজস্ব তো আমরাও বাড়াতে চাই। রাজস্ব বাড়ানোর জন্যই তো আমরা ‘‌কালো টাকার’ দৌরাত্ম্য কমাতে চাই, ‘‌কালো টাকার মালিকদের’ বিচার চাই। তাহলে ‘‌ত্রাণকর্তা’ আইএমএফ কেন সরকারকে শর্ত দিচ্ছে না যে তোমরা ‘‌কালো টাকা’ বন্ধ করো। ‘‌কালো টাকার’ মালিকদের বিচার করো, তাদের ধরো। আমরা তোমাদের সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থন করব। আমরা দুনিয়ার সব দেশকে তোমাদের সাহায্য করতে শর্ত দেব। আমরা দেশে দেশে রক্ষিত ‘কালো টাকা’ জব্দ করার ব্যবস্থা করব। জাতিসংঘের সাহায্য নেব, বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নেব। কই পাঠক, শুনেছেন এমন কথা আইএমএফ বলেছে—না বলেনি। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাতিসংঘ এসব ব্যাপারে কিছু বলে না। বরং ‘‌কালো টাকার’ মালিকরা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এরা বড় বড় আমলা, এরা বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, বড় বড় ‘বেনজীর’। এখন আমার প্রশ্ন আমাদের দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী, অর্থনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত বড় বড় আমলা, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), নানা মানবাধিকার সংস্থা ইত্যাদির কাছে তারা কেন প্রশ্নটি করছে না। তারা বলছে ‘‌কালো টাকাকে’ ‘‌সাদা’ করতে দেয়া যাবে না—কম ট্যাক্সে তো নয়ই। ‘‌কালো টাকার’ মালিকদের শাস্তি দিতে হবে। সব ঠিক আছে। কিন্তু যেখানে ‘কালো টাকার’ গন্তব্যস্থল সেসব ‘‌সভ্য, গণতান্ত্রিক ও উন্নত’ দেশকে কেন তারা প্রশ্ন করে না যে তোমরা ‘‌ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ দেখাতে পারো না। তোমরা আমাদের সুশাসনের কথা বলো অথচ সুশাসনের অন্যতম অন্তরায় ‘‌কালো টাকাকে’ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছ। কেন আমাদের অর্থনীতিবিদরা অন্যদেরসহ দল বেঁধে প্রেস ক্লাবের সামনে এসে বলবে না যে এসব দ্বিচারিতা বন্ধ করো। তোমরা আমাদের দেশের চোর, ডাকাত, খুনি, ঘুসখোর, কমিশনখোরদের ‘কালো টাকা’ বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করো। আমাদের দেশের অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে বাড়িঘর কিনছে, কোত্থেকে তারা টাকা পাচ্ছে তার খবর তোমরা নাও না। এটা কি আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উকিল, ডাক্তার, টিআইবি, বড় বড় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি মিডিয়া মালিকরা করবেন? করলে, দাবি তুললে একটা বিহিত হয়তো হতে পারত। কেন বলছি এ কথা?

এ কথা আমরা সবাই বুঝি যারা ‘‌কালো টাকা’ বানায় অসৎ পথে, চোরাচালান, হুন্ডি, ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে তারা এ টাকা ভোগ করতে চায়, আরাম-আয়াসে জীবনযাপন করতে চায়। ছেলেমেয়েদের জন্য ‘সোনার ভবিষ্যৎ’ রেখে যেতে চায়। বলা যায়, তারা আগের দিনের তালুকদার, জমিদারদের মতোই জীবনযাপন করতে চায়। ঢাকা শহরের চারদিকের বাগানবাড়ির খবর শুনে তাই মনে হয়। এখন মুশকিল হচ্ছে, ‘‌কালো টাকার’ রঙ তো আর কালো নয়। খুবই সাদা। কিন্তু সমস্যা ওই টাকা তারা রাখবে কোথায়? দেশে ‘‌মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন’ আইন আছে। অনেক কড়াকড়ি আইন। যারা ‘‌কালো টাকা’ আন্তর্জাতিকভাবে নিজ দেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তাদের জোরাজুরিতেই আইনটি করা হয়েছে বলে অনুমান। এর ফল কী? ১০ লাখ টাকা ব্যাংকে রাখতে গেলে তুলতে গেলে প্রশ্ন। চেকের টাকা পরিশোধের আগে ব্যাংকের ফোনের পর ফোন। ব্যাংকগুলো হয়েছে ‘‌পুলিশ’—আর সাধারণ সব লোক, আমানতকারী হচ্ছে সন্দেহের পাত্র। সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত করে খবর পাঠাতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। এমন কড়াকড়ির মধ্যে যারা ‘‌কালো টাকা’ বিলিয়ন বিলিয়ন বানাচ্ছে তারা করবে কী? দেশে যখন রাখা যায় না অতএব বিদেশে রাখা দরকার। কিছু টাকা জমি-স্বর্ণ-ডলারে লুকানো যায়। কিন্তু এটা খুব বেশি টাকা নয়। তাই রাখতে হবে বিদেশে। তা রাখার ব্যবস্থা আছে। আমাদের ব্যাংকগুলো এর ব্যবস্থা নিয়ম-নীতির মধ্যেই করে রেখেছে। বস্তুত টাকা পাচারের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক। তার হাতিয়ার আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং। অবমূল্যায়ন আর অতিমূল্যায়ন—তা অবশ্যই আমদানি রফতানির মাধ্যমে। টাকা যাবে বিদেশে তার গন্তব্যস্থলে। কখনো সরাসরি, কখনো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে। ব্রিটিশরা, ইউরোপীয় দেশগুলো ভীষণ চালাক। তারা চতুরতা করে বিদেশীদের ‘‌কালো টাকা’ রাখতে দেয় তাদের অধীনস্থ দ্বীপরাষ্ট্রে। এগুলোকে তারা করমুক্ত দেশ করে রেখেছে। কেইম্যান দ্বীপসহ এমন দ্বীপরাষ্ট্র অনেক। দুনিয়ার চোররা ওইসব দেশে টাকা রাখে ডলার হিসেবে। তা রাখার জন্য উকিল আছে। বিনিয়োগকারী কোম্পানি আছে। সেখানে টাকাকে ডলার করে সাফাই করা হয়। লন্ড্রির মতো। ওই ডলার যায় উন্নত বিশ্বে। বিশ্বের নামকরা বিনিয়োগ কোম্পানিগুলো ওই ডলার নিজ দেশে আনে। তা তারা সারা বিশ্বে বিনিয়োগ হিসেবে পাঠায়। আমরা অনেক ক্ষেত্রে আমাদেরই টাকা ডলার হিসেবে পাই ছদ্মনামে। এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। সবাই তা জানে। এই যে ব্যবস্থা তা অত্যন্ত শক্ত ব্যবস্থা। আমাদের দেশের ‘‌কালো টাকার’ মালিকদের টাকা যখনই তাদের হাতে পড়ে, তখন তার নিরাপত্তা শতভাগ। ‘‌কালো টাকার মালিকরা’ যেহেতু দেশে টাকা রাখতে পারে না। ব্যাংকে রাখার জোগাড় নেই এবং যেহেতু বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার/টাকা সাদাভাবে বিনিয়োগের সুযোগ দেশে নেই, তাই তারা উন্নত সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে ওই টাকা/ডলার রাখে। রাখে যে তার খবর প্রায়ই খবরের কাগজে কিছু ছাপা হয়। কারা অর্থ পাচারকারী তাদের নামও ছাপা হয়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে সভ্য, উন্নত দেশের সঙ্গে অনেক অগণতান্ত্রিক দেশও যোগ হয়েছে। যেমন দুবাই, যা এখন ‘‌কালো টাকার’ বড় গন্তব্যস্থল। মালয়েশিয়া, হংকং, ব্যাংকক তো আগেই ছিল। যে যে ভাবে পারে সেখানে সেভাবেই ব্যবসা করছে। খোলাখুলি। দৃশ্যত বাঙালিদের খুশি হওয়ার কথা। এক কোটিরও অধিক বাংলাদেশী বিদেশে ডলার রোজগার করছে। এ সুবাদে প্রচুর ডলার বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। ‘‌কালো টাকার’ মালিকদের জন্য পোয়াবারো। তারা পাচারকৃত টাকা দিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে, সহায়-সম্পদ করছে। এটা একদিকে কিন্তু আনন্দের খবরই হওয়ার কথা ছিল। না, তা নয়। ‘‌কালো টাকার’ অস্তিত্ব এ গৌরবকে ম্লান করে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সহজ ঘটনা! ‘‌কালো টকা’ সারা বিশ্বেই রাখার ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ ‘‌কালো টাকার’ গন্তব্যস্থল নিরাপদ। আর বাংলাদেশ অনিরাপদ ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা ‘‌কালো টাকা’ পছন্দ করি না। আমরা মনে করি ‘‌কালো টাকা’ আমাদের অর্থনীতির শত্রু। এ টাকা আমাদের শেষ করে দিচ্ছে। ‘‌কালো টাকার’ মালিকরা আমাদের সব অর্জন নষ্ট করে দিচ্ছে।

এই যে বিপরীতমুখী অবস্থা তার থেকে মুক্তি কোথায় ও কীভাবে? এক হতে পারে ‘কালো টাকার’ জন্ম আমরা যেভাবেই হোক বন্ধ করব। কিন্তু ৫০-৫২ বছর, এমনকি ১৯৪৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সময়ের অভিজ্ঞতা বলে ‘‌কালো টাকার’ জন্ম বন্ধ করা একরকম অসম্ভব। বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই এর পরিমাণ বাড়ছে, এর মালিকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ছে। দ্বিতীয় পথ ওই টাকা দেশে যাতে বিনিয়োগ হয় তার ব্যবস্থা করা। ওই টাকা যাতে ব্যাংকে রাখা যায় তার ব্যবস্থা করা। জনমত তা চায় না। মানুষ ‘‌কালো টাকার’ মালিকদের ঘৃণা করে। ট্যাক্স দিয়ে হলেও সাদা করাকে মানুষ পছন্দ করে না। আর মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইনেও তা সম্ভব নয়। এ কারণেও সুযোগ দিলেও ‘‌কালো টাকার’ মালিকরা টাকা ‘‌সাদা’ করতে এগিয়ে আসেনি। ভয় পায়, লজ্জা পায়। লোকলজ্জা ভীষণ বড় ব্যাপার। অতএব গত্যন্তর কী? ‘‌কালো টাকা’ বিদেশে রাখা। শত হোক উন্নত বিশ্ব হচ্ছে বিশ্বের চোরাদের ‘‌কালো টাকার’ ‘থায়িদ্বার’। গ্রামে গ্রামে চোরদের চুরি করা মাল নিরাপদে রাখার জন্য এক শ্রেণীর ধনীলোক থাকে। তাদের কাছে ওই মাল থাকলে কেউ সন্দেহ করে না। বস্তুত ‘‌গচ্ছিত’ রাখার ওই ব্যবস্থা না থাকলে চৌর্যবৃত্তি চালানো কঠিন হতো। আমাদের ‘‌কালো টাকার’ অবস্থাও হয়েছে তাই। উন্নত বিশ্ব আমাদের ‘‌কালো টাকা’ রাখার নিরাপদ স্থল—তারা ‘থায়িদ্বার’। এদিকে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী, অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, অধ্যাপক, বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলো ‘‌থায়িদ্বার’ সম্পর্কে কিছু বলতে উৎসাহী নন। এর কারণ খুঁজে বের করা দরকার। এরই মধ্যে যা হাওয়ার তাই হবে/হচ্ছে—বুঝ হে সুজন!

ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন