আলোকপাত

আর্থসামাজিক সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করতে হবে

মোহাম্মদ জমির

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস অর্থনৈতিক উন্নতির স্বাক্ষরবাহী। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আমরা অসাধারণ গল্প রচনা করেছি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশ এখন আর ‘‌তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে যেমনটা বলেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং তখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। কিন্তু বর্তমান যে চিত্র,  বিশ্বমঞ্চে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশ। সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করে সহস্রাব্ধের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের পথে এগোচ্ছি। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রায় নয় বছর আগেই ঘোষণা করেছিল যে, আমাদের অর্থনীতি ৭ শতাংশের অধিক সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এটা এর আগের ছয় বছরের তুলনায় একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বটে। এরপর করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সমর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এটা সত্য যে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে বেশ সক্ষমতা দেখাতে পারলেও বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব দূর করতে পারেনি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এতে কিছু কিছু উপখাতে দুর্নীতি ব্যাপৃত হয়েছে। 

বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আর্থসামাজিক পুনরুদ্ধার ও দারিদ্র্য দূরীকরণে যে কারণগুলো সামনে আনেন তার মধ্যে রয়েছে, ক) পরিষেবা খাত, বিশেষ করে জনপ্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মজুরি বৃদ্ধি এবং খ) বৃহৎ পরিসরে ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ ও পরিবহন খাতে প্রবৃদ্ধি। 

অর্থনীতিবিদরা মতামত দিয়েছেন যে, আপেক্ষিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন ধরনের মূলধনি যন্ত্রপাতির মূল্য হ্রাসও উদ্যোক্তাদের নতুন উদ্যোগে জড়িত হতে এবং তাদের বিদ্যমান ব্যবসার পরিধি সম্প্রসারণে উৎসাহিত করেছে।

কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের বিচ্ছিন্ন সংশয় সত্ত্বেও পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি) দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ২৫তম। ৪৫৫ বিলিয়ন ডলার জিডিপি নিয়ে বিশ্বের ৩৩তম বৃহৎ অর্থনীতি বাংলাদেশ। এইচএসবিসির পূর্বাভাস, বাংলাদেশ ২০৩০ সালে বিশ্বের ২৮তম এবং ২০৩৫ সালে ২৫তম অর্থনীতি হতে পারে।

বৈশ্বিক খাদ্য সূচকে আমাদের যথেষ্ট উন্নতির জায়গা রয়েছে। ২০২৩ সালে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১২৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮১তম। অবশ্য শিশু স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা ও বেশ কয়েকটি সূচকে ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছি আমরা। 

দারিদ্র্য একটি বহুমুখী ধারণা যাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উপাদান জড়িত। নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য বলতে বোঝায় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলো পরিপূর্ণ করতে পারার অসামর্থ্য। আর আপেক্ষিক দারিদ্র্য সমাজের বাকি অংশের তুলনায় ব্যক্তি বিশেষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে। 

মৌলিকভাবে দারিদ্র্য হলো পছন্দ তথা সুযোগের অভাব, যাকে মানুষের মর্যাদার লঙ্ঘন বলা যায়। এটি সমাজে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার মৌলিক ক্ষমতার অভাবকে বোঝায়। এছাড়া পরিবারের জন্য খাদ্য ও পোশাকের অপর্যাপ্ততা, স্কুল বা ক্লিনিকের অভাব, নিজের খাদ্য উৎপাদনের জন্য জমি বা জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরি কিংবা ঋণ গ্রহণের ব্যবস্থা না থাকাকে বোঝায়। এর অর্থ হলো, অনিরাপত্তা, ক্ষমতাহীনতা এবং পরিবার বা সমাজের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা; সহিংসতার প্রতি সংবেদনশীলতা যা উৎসারিত হয় পরিষ্কার পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা ছাড়া প্রান্তিক বা ভঙ্গুর পরিবেশে জীবনধারণের কারণে। দারিদ্র্যের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিষ্কার পানি ও স্বাস্থ্যবিধি নিম্নমানের হওয়ায় শারীরিক নিরাপত্তার অপর্যাপ্ততা, প্রতিবাদহীনতা ও জীবনের উন্নতির জন্য ক্ষমতা ও সুযোগের অপর্যাপ্ততাও অন্তর্ভুক্ত। 

নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য হলো চরম দারিদ্র্য বা অতিদারিদ্র্য—মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পরিপূরণের একটি বঞ্চিত অবস্থা, যা নির্দেশ করে নিরাপদ পানি, বিধিসম্মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুবিধা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও তথ্য প্রাপ্তির অভাব। এটা কেবল আয়ের ওপর নির্ভর করে এমন নয়, বরং পরিষেবাগুলোর নিশ্চিত প্রাপ্তির ওপরও অনেকটা নির্ভর করে। ‘নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য’ পরিভাষাটি ফ্যাশন হিসেবে ‘অতিদারিদ্র্য’-এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা নিরঙ্কুশ বা চরম দারিদ্র্য বলতে ‘‌অপুষ্টি, নিরক্ষরতা, রোগ, নোংরা পরিবেশ, উচ্চ হারে শিশুমৃত্যু ও গড় আয়ুর দ্বারা একটি সীমিত অবস্থা, যা প্রকৃতভাবেই মানুষের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে’ এমন পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন। 

দারিদ্র্যকে অসম সামাজিক অবস্থা ও সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অপরের ওপর নির্ভরশীলতা, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ কিংবা সমাজের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির অভিজ্ঞতার আলোকে বোঝা সম্ভব। 

সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন, দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছে এমন মানুষগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনতে তাদেরকে সমাজের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে দেশে বিরাজমান দারিদ্র্য হ্রাস করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ ও শহুরে পরিসরের বিভাজনগুলোকে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমগুলোর ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে এবং অর্থনৈতিক খাতগুলোর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছে। অত্যন্ত সঠিকভাবে তারা বারবার বাংলাদেশকে সতর্ক হতে বলছে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে জবাবদিহিতা জোরালো করতে আহ্বান জানাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামো শক্তিশালী করা, গুণগত মানের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, শাসন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।

এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, এতে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হবে। এটাও জোর করে বলতে হবে যে, জনসাধারণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অবকাঠামোতে বিনিয়োগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিপ্রেক্ষিতে আলোকপাত করা হয় যে, বাংলাদেশ দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে অরক্ষিত ছিল এবং অভিযোজন ও প্রশমনের মাধ্যমে জলবায়ুর পরিবর্তনশীলতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছিল। 

এগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) র‍্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকার ব্যাপারে আরো যোগ করা যায়, আমাদের রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আয়, আমাদের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়, মুদ্রাস্ফীতির আপেক্ষিক নিয়ন্ত্রিত অবস্থা, রফতানি খাতে আয় বৃদ্ধি, আমাদের নির্ভরশীলতার অনুপাতের হ্রাস, মানব উন্নয়ন সূচক, অপেক্ষাকৃত উন্নত শিক্ষা সুবিধা, লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সাফল্য। যা-ই হোক, আমাদের দৃষ্টি খাদ্যনিরাপত্তা এবং অনেক উপজেলাসংশ্লিষ্ট গ্রামের, যেমন (ভুরুঙ্গামারী, চর রাজিবপুর, চিলমারী, ফুলবাড়ী, রাজারহাট, উলিপুর, বাকেরগঞ্জ, হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, কুড়িগ্রামের কিছু উপজেলা, বরিশাল, চাঁদপুর ও জামালপুর) জীবনযাত্রার মান দরিদ্রতর পর্যায় থেকে দারিদ্র্যের পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং শহুরে এলাকাগুলোর আয়ের ক্ষেত্রে বর্ধিত অসমতা দূর করে ভারসাম্য সৃষ্টিতে আলোকপাত করা প্রয়োজন, হোক সেটা ঢাকা বা চট্টগ্রাম। 

আমরা যদি তা করতে পারি, তাহলে আমরা অবশ্যই ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্য পূরণ করতে পারব। বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এটা বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ হলো একটি দেশ, যেখানে গ্রামীণ পরিসরে প্রচেষ্টাগুলোর রাজনীতিকরণ দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সাম্প্রতিক সময়ের গৃহীত পদক্ষেপগুলোয় কেবল অন্তরায়ই তৈরি করতে পারে। আমাদের সুইডেন ও নরওয়ের কাছ থেকে শেখা প্রয়োজন। তবে আমাদের অবশ্যই এটা ভুললে চলবে না যে, আমাদের বলয় থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ লৈঙ্গিক সমতা এবং আমাদের তরুণ প্রজন্মের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি করবে। 

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত; পররাষ্ট্র, তথ্যের অধিকার ও সুশাসন বিষয়াদির লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন