ঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক

নীতি সুদহার বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই সে নীতি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। ঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এখন থেকে ব্যাংকগুলো চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কও বিবেচনায় নিতে পারবে। সুদহার শতভাগ বাজারভিত্তিক করতে ‘স্মার্ট’ নীতি প্রত্যাহার করা হলো।

এদিকে আরেক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নীতি সুদহার বা রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নীতি অনুযায়ী, আজ থেকে রেপো রেট হবে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রজ্ঞাপনে নীতি সুদের করিডরের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমাও বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ক্ষেত্রে সুদহার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে এবং নীতি সুদহার করিডরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার আরো বাড়বে। গত মাসে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরুতে এসে সর্বোচ্চ সুদের এ সীমা তুলে নেয়া হয়। এর পর থেকে ঋণের সুদহার ক্রমাগত বেড়েছে। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে দেশে ঋণের সুদহার বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। 

চলতি বছরের শুরু থেকেই ক্রমাগত ঋণের সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ মার্চেও দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। টানা ২২ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদদের দাবি, দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার বিবিএসের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।

ঋণের বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণে ব্যাংকগুলোকে পাঁচটি নির্দেশনা পরিপালন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলো হলো ব্যাংকগুলো ঋণের খাতভিত্তিক সুদহার ঘোষণা করবে এবং তুলনামূলক ঝুঁকি বিবেচনায় গ্রাহকভেদে ঘোষিত হারের চেয়ে ১ শতাংশ কম বা বেশি হারে ঋণ বিতরণ করতে পারবে। মঞ্জুরিপত্রে সুদহার অপরিবর্তনশীল বা পরিবর্তনশীল কিনা, তা উল্লেখ থাকতে হবে। কোনো ঋণের সুদহার পরিবর্তনশীল হলে তা বছরে সর্বোচ্চ কতবার বৃদ্ধি করা হবে এবং কত শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে সেটিও আবশ্যিকভাবে মঞ্জুরিপত্রে উল্লেখ থাকতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, কোনো ঋণ অথবা ঋণের কিস্তি সম্পূর্ণ বা আংশিক মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হলে যে সময়ের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ হবে, সেই সময়ে চলমান ঋণ বা তলবি ঋণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ঋণস্থিতির ওপর এবং মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির ওপর সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ শতাংশ দণ্ড সুদ আরোপ করা যাবে। ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত সুদহারের অতিরিক্ত কোনো সার্ভিস চার্জ আদায় করা যাবে না। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার কর্তৃক গঠিত প্রণোদনা প্যাকেজ, বিশেষ তহবিল, পুনঃঅর্থায়ন, প্রাক-অর্থায়ন তহবিলের আওতায় দেয়া ঋণের সুদহার নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট তহবিলের জন্য প্রণীত নীতিমালা প্রযোজ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

দেশের ব্যাংক খাতে এ মুহূর্তে তীব্র তারল্য সংকট চলছে। দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি) একদিন মেয়াদি ধারের সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। সুদহার এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও কলমানি বাজারে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থ মিলছে না। এজন্য ব্যাংকগুলোকে দৈনন্দিন লেনদেন সম্পন্ন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার বাড়াতে হচ্ছে। যদিও বাজারে অর্থের সরবরাহ কমানোর কথা বলে নীতি সুদহার (রেপো) কয়েক দফায় বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এখন প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করছে। 

তারল্য সংকট তীব্র হওয়ায় সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও বাড়ছে। গত সপ্তাহে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার উঠেছে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশে। এর চেয়ে বেশি মেয়াদি সুদের হার আরো বেশি। উচ্চ এ সুদেই ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার।

এদিকে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটি মনে করে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দুটি সংকটপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। চ্যালেঞ্জ দুটি হলো মূল্যস্ফীতির অব্যাহত উচ্চহার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমাগত অবক্ষয়। এ দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন