যশোরে বজ্রপাতে আট বছরে মৃত্যু হয়েছে ৪৮ জনের

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, যশোর

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

গত এক দশকে ঝড়, বন্যা বা অন্য কোনো দুর্যোগের তুলনায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। গত আট বছরে যশোরে বজ্রপাতে ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দুটি শিশু, নারী সাতজন ও পুরুষ রয়েছে ৩৬ জন। জেলা প্রশাসকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ পুনর্বাসন অফিসের তথ্যমতে, মারা যাওয়া অধিকাংশ ব্যক্তিই বয়সে তরুণ ও মাঝবয়সী। যারা খেলার মাঠে বা কৃষি খেতে বজ্রপাতে মারা গেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার ধরন বদলে যাওয়া ও বড় গাছ কেটে ফেলার কারণে বজ্রপাত বেড়েছে। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিলে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৭ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ঝিকরগাছা উপজেলার বড় পৌদাউলিয়া গ্রামে ধানে কীটনাশক দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন আব্দুল মালেক পাটোয়ারী (৬৫)। এমন সময় বজ্রপাতে তিনি মারা যান। বজ্রপাতে মালেকের পিঠের কিছু অংশ ঝলসে যায়। এছাড়া গত বছরের ১৫ জুলাই চৌগাছা উপজেলার ফতেপুর বেড়গোবিন্দপুর বাঁওড়সংলগ্ন একটি খেতে ঘাস কাটছিলেন কৃষক আমিনুর রহমান (৪৫)। এমন সময় বজ্রপাতে তিনি মারা যান। ওই বছরের ২২ জুন একই উপজেলার তিলকপুর গ্রামের পশু চিকিৎসক আমিনুর রহমান মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে বেলেমাটি মাঠের মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হয়। এ সময় বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়। আব্দুল মালেক ও আমিনুরের মতো গত আট বছরে যশোরে ৪৮ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ জন। তবে আহতরা প্রাণে বেঁচে গেলেও কোনো না কোনোভাবে শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।

যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ছোলজার রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতি বছর ভূপৃষ্ঠ থেকে নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়। ফলে মাটি ও পৃথিবীপৃষ্ঠে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রোজেনের ঘাটতি যত বেশি হবে বজ্রপাতও তত বেশি হবে। নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয় প্রাকৃতিক ও মানবীয় কারণে। আমরা জমিতে অতিমাত্রায় চাষাবাদ করছি। জমিকে বিশ্রাম দিচ্ছি না। আগে একটা ফসল ফলানোর পর চার-পাঁচ মাস বিশ্রাম পেত। ফলে বজ্রপাত তেমন একটা হতো না। এখন ঘন ঘন চাষের মাধ্যমে নাইট্রোজেনের যৌগগুলো বায়ুমণ্ডলে চলে যাচ্ছে। ফলে ভূপৃষ্ঠে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমায় আবহাওয়ার ধরনও বদলে গেছে। এজন্য জমিতে জৈবসারের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং অতিমাত্রায় সার ছিটানো যাবে না।’

জেলা প্রশাসকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ পুনর্বাসন অফিস তথ্য মতে, দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় মার্চ থেকে জুনে। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় মার্চ-জুন পর্যন্ত। যারা ঘরের বাইরে থাকে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। এক্ষেত্রে কৃষক বা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের মৃত্যু বেশি হয়।

ফিনল্যান্ডভিত্তিক বজ্রপাত বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার সাত বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ শতাংশ ঘটনা ঘটে কৃষিকাজ করার সময়। এছাড়া বাড়ি ফেরার পথে সাড়ে ১৪ এবং গোসল করা ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছে, শহরে বজ্রপাত প্রতিরোধে বেশির ভাগ ভবনে প্রতিরোধক দণ্ড রয়েছে। ফলে শহরে মানুষের মৃত্যু হয় কম। কিন্তু গ্রামে, বিশেষ করে ফসলের মাঠে সেই ব্যবস্থা নেই। এ কারণে সেখানে মৃত্যু বেশি হয়। বজ্রপাত প্রতিরোধে গত আট বছরে অর্ধ লক্ষাধিক তালের চারা রোপণ করেছে যশোর জেলা প্রশাসন। কিন্তু এ ব্যবস্থা সময়সাপেক্ষ। তাই সচেতনতা সৃষ্টি ও পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মুহাম্মদ রিজিবুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বজ্রপাত বাড়ছে বিধায় মানুষও মারা যাচ্ছে বেশি। আমরা সেভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারিনি। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে জেলে ও কৃষক। তাদের কাছে আমরা বজ্রপাতের পূর্বাভাস পৌঁছাতে পারছি না। তারাও নিশ্চয়ই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহে বাইরে যাচ্ছে। যাওয়ার পর তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন