বাজার তৈরি হওয়ায় বেড়েছে অপ্রচলিত দেশী ফলের চাষ

শাহাদাত বিপ্লব

ছবি : বণিক বার্তা

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতে। এতে কয়েক দশকের ব্যবধানে দেশী ফলভাণ্ডারের অর্ধেকেরও বেশি বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণের পাশাপাশি কৃষি বিভাগের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি বিদেশী ফল ও হাইব্রিড জাত দেশী ফলের উৎপাদন হ্রাস ও বিলুপ্তির জন্য অনেকখানি দায়ি বলে তাদের অভিমত।

প্রকৃতিতে একসময় প্রায় সারা বছরই কয়েক প্রজাতির ফলের দেখা মিলত। যদিও সবচেয়ে বেশি ফল পরিপক্ব হওয়ার মৌসুম গ্রীষ্ম ও বর্ষা। এ সময় ঝোপঝাড়ে, বনে-প্রান্তরে উঁকি মারে নানা ধরনের পাকা ফল। মূলত দেশী ফল রয়েছে দুই ধরনের—প্রচলিত ও অপ্রচলিত। এর মধ্যে প্রচলিত ও বিদেশী কিছু ফলের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ হলেও অতিমাত্রায় নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে অপ্রচলিত ফলগুলো চাষাবাদ হয়নি। এক পর্যায়ে প্রায় হারাতেই বসেছিল এসব ফল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে বিলুপ্তাপ্রায় ফল উৎপাদন ও সম্প্রসারণে তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। আবার সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের মাঝে পুষ্টিসচেতনতা বৃদ্ধি, উন্নত জাত ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা থাকায় অপ্রচলিত এসব ফলের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। কিছু কিছু ফল রফতানিও হচ্ছে। 

পাবনার কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা। নিজের ৩০-৩২ বিঘা জমিতে তিনি শরিফা ফলের চাষাবাদ করেন। এর বাইরে আরো পাঁচ-ছয় বিঘা জমিতে আতা, বেল, কদবেলসহ বিভিন্ন অপ্রচলিত ফলের বাগান করেছেন। বণিক বার্তাকে এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘দেশে ধান ও ভুট্টা বেশি চাষাবাদ হয়। সে হিসেবে জমির প্যাটার্নের ভিত্তিতে অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন ফল উৎপাদন হয়। অপ্রচলিত ফল নিয়ে খুব কম মানুষ ভাবে। যাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা আছে তারাই কেবল পরীক্ষামূলকভাবে এসব ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের ঝুঁকি নেন। কারণ জমির ভাড়া ও উৎপাদন খরচ মিলিয়ে একটা বড় অংশ ব্যয় করার সামর্থ্য না থাকলে কেউ সহজে এতে আসতে চান না। তবে এখন অপ্রচলিত ফলের চাষাবাদ বাড়ছে। মানুষ আগ্রহী হচ্ছে। আমার থেকেই অনেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। দেশে এখন নতুন করে অপ্রচলিত ফলের বাজার তৈরি হচ্ছে। দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে।’

কৃষিসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে প্রায় ১৩০ ধরনের অপ্রচলিত ফল রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ধরনের ফল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে এবং স্বল্প পরিসরে চাষও হয়। দেশে অপ্রচলিত ফলগুলোর মধ্যে রয়েছে আতা, শরিফা, বিলম্বি, করমচা, গাব, বিলাতি গাব, বিচিকলা, গোলাপজাম, ডেউয়া, আঁশফল, জামরুল, বেল, কদবেল, চালতা, সফেদা, লটকন, তিতিজাম ইত্যাদি।

বিদেশী ফলের গুণ নিয়ে বেশি প্রচারের কারণে মানুষ ফল বলতে আঙুর, কমলা, আপেল মনে করে। অথচ দেশী ফলগুলোয় রয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি খাদ্য উপাদান। প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে বলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও অনেক বেশি। অন্যদিকে দেশী ফলের গাছ রোগবালাই ও পরিবেশ প্রতিকূলতায় টিকে থাকতে পারে বলে সহজেই আবাদ করা যায়। দারিদ্র্য দূরীকরণেও এসব ফল চাষ সহায়ক হতে পারে। 

অপ্রচলিত ফল উৎপাদন ও সম্প্রসারণে ২০২০ সালে তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি হাতে নেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে এ কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হয় গত বছরের জুনে। এর মাধ্যমে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের ১৫ উপজেলায় অপ্রচলিত সব ফল গাছের সমন্বয়ে মিশ্র ফল বাগান ও বসতবাড়িতে ফল বাগান তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়।

কর্মসূচিটির পরিচালক ছিলেন মাসুমা জান্নাত। বর্তমানে তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের ধান, গম ও পাটবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের মনিটরিং অফিসার হিসেবে কর্মরত। আগের প্রকল্প নিয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচির মাধ্যমে অপ্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় কিন্তু বাজারে অর্থনৈতিক মূল্য আছে এমন ফলগুলো কৃষকের চাহিদার ভিত্তিতে দিয়েছিলাম। যেমন আতা, শরিফা, কদবেল, বেলসহ বিভিন্ন ফল চাষে কৃষক আগ্রহী হয়েছেন। প্রায় ৩০০টি বাগান আমরা করেছি, যার প্রত্যেকটিতে ৪০টি করে গাছ ছিল। আমাদের প্রকল্প থেকে যেসব প্রদর্শনী দেয়া হয়েছিল এখন সেসব গাছে ফুল বা মুকুল আসতে শুরু করেছে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে জামরুল উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৭৬৭ টন। এছাড়া আতা ৫ হাজার ৭৭০ টন, লটকন ২ হাজার ৪০৯, শরিফা ২ হাজার ২২৯, করমচা ১৬৬, ডেউয়া ১ হাজার ৬২৯, কদবেল ৩০ হাজার ৯, চালতা ১০ হাজার ৫৩১ ও সফেদা ৬ হাজার ৫৭৩ টন উৎপাদন হয়েছে। 

উৎপাদিত এসব ফল এখন রফতানিও হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে লটকন, কদবেল, চালতা, বেল, সফেদা, গাব ও অড়বরই বিভিন্ন দেশে রফতানি করে বাংলাদেশ।

টেকসই ও লাভজনক উদ্যান ফসল উৎপাদন বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে টাঙ্গাইল হর্টিকালচার সেন্টার। চাহিদাভিত্তিক ও সমন্বিত কৃষি সম্প্রসারণ সেবা দেয়ার মাধ্যমে সব শ্রেণীর কৃষকের প্রযুক্তিজ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতেও কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সেন্টারটির নার্সারির তত্ত্বাবধায়ক (সংযুক্ত) মো. আব্দুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটা সময় প্রচুর প্রচলিত ফল দেখা যেত, খুঁজে পাওয়া যেত, কিন্তু এখন সচরাচর দেখা যায় না। দেশে প্রায় ১৩০ ধরনের অপ্রচলিত ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন এসব ফল প্রায় বিলুপ্তির পথে। সরকার এ ফলগুলো ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের এ হর্টিকালচার সেন্টারে প্রতি বছরই নানা ধরনের অপ্রচলিত ফলের চারা উৎপাদন করছি এবং বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও কৃষকদের এসব ফলের বাগান করতে উৎসাহিত করছি। চারা উপহার দিচ্ছি।’

কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, বিলুপ্তপ্রায় বা অপ্রচলিত ফলগুলো আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী। এ কারণে এসব ফল চাষে খুব বেশি চ্যালেঞ্জ নেই। আবার রোগবালাইও হয় কম। এসব ফলের নতুন জাত উদ্ভাবন করা গেলে কৃষক এসব ফল চাষে আরো আগ্রহী হবেন।  

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে একসময় আমাদের দেশীয় কিছু ফল হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অপ্রচলিত বা বিলুপ্তপ্রায় ফলগুলো চাষে কৃষক আগ্রহী হচ্ছেন। মানুষ এখন অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় পুষ্টি নিয়ে সচেতন। আমাদের দেশীয় ফলগুলোয় প্রচুর পুষ্টি রয়েছে। এ কারণে অনেকেই সখের বশে চাষ করছেন। আবার সচেতনতার কারণে এর একটি বাজারও তৈরি হয়েছে। বেল, কদবেল, আতা, শরিফা এসব ফল এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষা হচ্ছে। কৃষকও লাভবান হচ্ছেন। আবার আগে উন্নত জাত ছিল না। এ কারণে অনেকেই এসব ফল চাষাবাদে আগ্রহ পেতেন না। কিন্তু এখন বারি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন জাত এনেছেন। বারির বিলাতি গাবের জাত রয়েছে। বারি থেকে অপ্রচলিত ফলের ২০-২২টি ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।’ 

দেশে লবণাক্ততা, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যাসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে দেশীয় এসব ফল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে। সার্বিকভাবে আলাদা যত্নেরও প্রয়োজন হয় না। এ কারণে আরো ভালো জাত বা জাতের সহজলভ্যতা নিশ্চত করতে পারলে কৃষক আগ্রহী হবেন বলে মনে করছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কেজেএম আব্দুল আউয়াল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে আগ্রহের গুণগত মানে পরিবর্তন এসেছে। প্রায় সবাই এখন দেশী ফল বেশি পছন্দ করছে। বাজারে এসব ফলের দামও বেশি পাওয়া যায়। তাই বাণিজ্যিকভাবে এর ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চ্যালেঞ্জও রয়েছে কিছু। বাড়ির আঙিনা ছোট হয়ে আসছে। ফলে এসব গাছও আলাদা করে উৎপাদনের জায়গা আগের মতো নেই। তবে দেশী ফলগুলোর চারা উৎপাদনে আমরা সবসময় কাজ করি। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অপ্রচলিত ফল চাষে উৎসাহ দিই। আতা, ডেউয়া, শরিফা, কদবেল, বেল—এসব ফলের চারা বিনামূল্যে কৃষকদের দেয়া হয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন