বিমানবন্দরে বিদেশী মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ে কারসাজি

১৯ ব্যাংকারসহ ২১ জনের নামে দুদকের মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

জনতা, সোনালী, অগ্রণী ও এমটিবির ১৯ ব্যাংকার এবং দুই মানি এক্সচেঞ্জারের দুই কর্মকর্তার নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ডলার ও অন্যান্য বিদেশী মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ে কারসাজি ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এ মামলা হয়েছে। গতকাল দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম মামলাটি করেন।

আসামিরা হলেন জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মো. সুরুজ জামাল, প্রিন্সিপাল অফিসার শামীম আহমেদ ও মো. আশিকুজ্জামান, সিনিয়র অফিসার অমিত চন্দ্র দে, মো. মানিক মিয়া, সাদিক ইকবাল, মো. সুজন আলী, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার আনোয়ার পারভেজ, সিনিয়র অফিসার মো. হুমায়ুন কবির; সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মো. সোহরাব উদ্দিন খান, সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) মো. শরীফুল ইসলাম ভূইয়া, সিনিয়র অফিসার মোহাম্মদ সবুজ মীর, সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) খান আশিকুর রহমান, এবিএম সাজ্জাদ হায়দার, মো. কামরুল ইসলাম, অফিসার সামিউল ইসলাম খান, সাপোর্টিং স্টাফ মো. মোশারফ হোসেন; অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মো. আব্দুর রাজ্জাক; মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের অফিসার মো. আবু তারেক প্রধান, এভিয়া মানি চেঞ্জারের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার মো. আসাদুল হোসেন ও ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএম কবির আহমেদ।

তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/ ৪২০/ ৪৬৭/ ৪৬৮/৪৭১/১০৯; দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২); মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ও ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৪৭-এর ২৩(১) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ বিষয়ে গতকাল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, ‘বিমানবন্দরে দায়িত্ব অবস্থায় আসামিদের বিরুদ্ধে বিদেশী মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ে কারসাজি ও মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে অর্থ পাচারকারীদের কাছে তা অবৈধভাবে সরবরাহ করেছেন। অবৈধভাবে ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের কারণে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। অবৈধ এসব অর্থ দেশের বাইরে পাচার হতে পারে।’

এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, জাল ভাউচার তৈরি করে প্রবাসী ও বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে সংগৃহীত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে অন্তর্ভুক্ত না করে বেআইনিভাবে কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। আসামিরা বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশমালা ও ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৪৭ অনুযায়ী অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধ করেছেন।

বিদেশী মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ে ও মানি লন্ডারিংয়ে জনতা, সোনালী, অগ্রণী, মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এভিয়া মানি চেঞ্জার ও ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ জড়িত থাকার বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। অপরাধে জড়িতরা অবৈধভাবে ক্রয়কৃত ডলার, ইউরো, রিয়াল, রিঙ্গিত, পাউন্ড, দিনার ও অন্যান্য মুদ্রা সংগ্রহ করে পাচারকারী ও কালোবাজারিদের কাছে অবৈধভাবে সরবরাহ করেছেন। বিদেশ থেকে আসা এবং বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিদের কাছে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ ও মানি চেঞ্জার হাউজ রয়েছে। প্রবাসীরা পাসপোর্ট দেখিয়ে বিদেশ থেকে আনা বৈদেশিক মুদ্রা বিমানবন্দরে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে ভাউচারের মাধ্যমে এনক্যাশমেন্ট করে দেশী মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর কাস্টমস বুথে বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণের ট্যাক্সসহ অন্যান্য রাজস্ব আহরণের জন্য বাংলাদেশী মুদ্রা গ্রহণের নিয়ম রয়েছে। এছাড়া বিদেশী নাগরিক যারা ভিসার মেয়াদের চেয়েও বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করেন তাদের জরিমানা আদায় করা হয় ডিপার্চারের ওভার স্টে বুথে, যেখানে বেশির ভাগ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করেন।

বিদেশী মুদ্রা বিমানবন্দরে থাকা ব্যাংকের বুথ ও মানি এক্সচেঞ্জারে দেশীয মুদ্রা বা বাংলাদেশী টাকায় এনক্যাশমেন্ট করা হয়। আইন, বিধি ও নিয়ম অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট প্রদর্শন ও ভাউচার বা এনক্যাশমেন্ট স্লিপ প্রদান, লেজার বা সিস্টেমে এন্ট্রি করে যথাযথভাবে হিসাব রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ব্যাংকের অধিকাংশ বুথ ও মানি এক্সচেঞ্জ বুথে দায়িত্বরত অসাধু কর্মকর্তারা তা প্রতিপালন করছেন না। ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জারের অসাধু কর্মকর্তারা ভাউচার না দিয়ে বা জাল ভাউচার দিয়ে সরাসরি ফরেন কারেন্সি গ্রহণ করে তার বিনিময়ে টাকা দিয়ে দেন। এছাড়া তারা স্বাক্ষরবিহীন, ভুয়া ভাউচার বা এনক্যাশমেন্ট স্লিপ দেন। এ বিদেশী মুদ্রা ক্রয়কারী ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূল হিসাবে বা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত অ্যাকাউন্টে অন্তর্ভুক্ত করে না। এছাড়া ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা ব্যাংকের তহবিল ব্যবহার করে মাঝে মাঝে নিজের টাকা দিয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে ব্যাংক নির্ধারিত হারে অথবা তার চেয়ে কম হারে ভাউচারবিহীন অথবা ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করে তা লাভের বিনিময়ে এয়ারপোর্টে অবস্থিত এভিয়া মানি চেঞ্জারের কাছে অথবা বাইরে কার্ব মার্কেটে কিংবা কালোবাজারে বিক্রি করে দেন। বিক্রির পর প্রাপ্ত টাকা থেকে ব্যাংকের তহবিল সমন্বয় করে লভ্যাংশটা অসাধু ব্যাংকাররা নিজের পকেটে রেখে দেন। ফলে কেন্দ্রীয় রিজার্ভে এসব বিদেশী মুদ্রা যুক্ত হয় না। এতে বাংলাদেশে বিদেশী মুদ্রার ঘাটতি বা সংকটের সৃষ্টি হয়।

এছাড়া এভিয়া মানি চেঞ্জারের আসাদুল হোসেন ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়ের জন্য ব্যাংকের বুথগুলোয় প্রতিদিন প্রতি শিফটের জন্য ২০-৩০ লাখ টাকা রেখে দিতেন। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা ওই টাকা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে তা আসাদুলকে সরবরাহ করতেন। এভিয়া মানি চেঞ্জারে আসাদুল হোসেনের সঙ্গে কেউ অবৈধ লেনদেনে রাজি না হলে তাদের ওপর চাপ তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করানো হতো। আসাদুল হোসেন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে ওই পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা বিমানবন্দরের বাইরে কার্ব মার্কেটে বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের কাছে উচ্চ দরে বিক্রি করেন।

ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেড বিদেশী পর্যটক ও বিদেশ প্রত্যাগত বাংলাদেশী নাগরিকদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা, নোট, কয়েন ও ট্রাভেলারস চেক কেনার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ছক মোতাবেক বিক্রেতাকে যথাযথভাবে প্রত্যয়নপত্র দিত না। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের প্রমাণস্বরূপ নগদায়ন প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে বিক্রয় করত না। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের বিস্তারিত বিবরণ সঠিক ও সম্পূর্ণভাবে হিসাব বইতে সংরক্ষণ ছাড়াই ভাউচারবিহীন ও ভুয়া ভাউচার দেয়ার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাউচারে পাসপোর্ট নম্বর, নাম, জাতীয়তা, রিসিভারস সিগনেচার পূরণ করার বিধান ও পাসপোর্ট নম্বর বাধ্যতামূলকভাবে লেখার নিয়ম রয়েছে। বাস্তবে কোনোটিতে পাসপোর্ট নম্বর নেই, কোনোটিতে কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর নেই আবার কোনোটিতে রিসিভারস সিগনেচার নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন