দুই বছরে দ্বিগুণ হয়েছে সরিষা উৎপাদন

শাহাদাত বিপ্লব

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে সরিষা উৎপাদন দুই বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছে সরিষা তেল উৎপাদনও। ফলে দাম কমে আসায় ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার ব্যবহার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সরিষার তেল উৎপাদন ও বিপণনে যুক্ত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানও। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর আগে দেশে সরিষা তেলের দাম সয়াবিনের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। তবে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় সয়াবিনের দাম দেশের বাজারে বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরিষা উৎপাদন বাড়াতে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ প্রকল্পের সুবাদে কমতে থাকে সরিষা তেলের দাম। বর্তমানে খোলা সরিষা তেল ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম কাছাকাছি। ফলে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার ব্যবহার আগের চেয়ে বেড়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ইউএসডিএর ‘অয়েল সিডস অ্যান্ড প্রডাক্টস অ্যানুয়াল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ বিপণন বর্ষে (অক্টোবর-সেপ্টেম্বর) দেশে সরিষা তেলের সরবরাহ ছিল ৫ লাখ ৬০ হাজার টন। এর মধ্যে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার হয় ৪ লাখ ৯৫ হাজার টন। এরপর ২০২২-২৩ বিপণন বর্ষে মোট সরিষা তেল সরবরাহ হয় ৫ লাখ ৫১ হাজার টন। এর মধ্যে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার হয় পাঁচ লাখ টন। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ বিপণন বর্ষে সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়ে দাঁড়াবে ৬ লাখ ৮৫ হাজার টনে। এর মধ্যে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হবে ৬ লাখ ৩০ হাজার টন। ইউএসডিএর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ বিপণন বর্ষে বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার ব্যবহার বেড়ে হবে ৬ লাখ ৬০ হাজার টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে দেশে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে ১৭ লাখ ৪৪ হাজার টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়। এরই মধ্যে ১০ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টন সরিষা উৎপাদন হয়েছে। গত অর্থবছর দেশে ৮ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৬৩ হাজার টন। যদিও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে সরিষা উৎপাদন ছিল ৬ লাখ ৫ হাজার টন। এক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ লাখ ৮৩ হাজার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ৮৭ হাজার ও ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৫৪ হাজার টন।

সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাঁচ বছর মেয়াদি ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ২২২ কোটি টাকার এ প্রকল্প ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। দেশের ২৫০টি উপেজলায় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্প চলবে।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে ১৮ লাখ হেক্টর জমিতে ২৬ লাখ টন সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পের অধীনে চলতি অর্থবছর থেকে ভোজ্যতেলে আমদানিনির্ভরতা কমাতে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরো ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে নয় লাখ টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ভোজ্যতেলের ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটাবে।

শুরুতে প্রকল্প পরিচালক ছিলেন মো. জসীম উদ্দিন। বর্তমানে তিনি অবসরে রয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা দানাজাতীয় শস্য ও ফলমূলে এগিয়ে গেলেও ভোজ্যতেলে অনেক পিছিয়ে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরিষা চাষে উৎসাহিত করতে কৃষককে প্রণোদনার মাধ্যমে সার ও বীজসহায়তা দেয়া হয়। ফলে অনেকেই এখন সরিষা চাষে ঝুঁকছেন। সরিষা একটি বাড়তি ফসল। অন্য ফসল কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আমাদের লক্ষ্য ছিল তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ পূরণ করা।’

ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ বিপণন বর্ষে সয়াবিন তেল উৎপাদন হবে ৬ লাখ ৪০ হাজার টন। যদিও সংস্থাটি এর আগে ৫ লাখ ১৮ হাজার টনের আভাস দিয়েছিল।

মূলত অভ্যন্তরীণভাবে সরিষা উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় তেল উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া উৎপাদন ও ভোগ বেড়ে যাওয়ায় দেশে বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন সরিষা তেল উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে পারটেক্স গ্রুপ, প্রাণ ফুডস লিমিটেড, সিটি গ্রুপ, মেঘনা, স্কয়ার, এসিআই ও ওরিয়ন অন্যতম।

ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাদ ও ঘ্রাণের কারণে দেশের মানুষ সয়াবিন ও পাম অয়েলের চেয়ে সরিষা তেল রান্নায় ব্যবহার করতে পছন্দ করে। আবার সয়াবিন ও পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধি ও সরিষা তেলের দাম কমে আসায় অনেকেই এখন রান্নার কাজে সরিষা তেল ব্যবহার করছে। চলতি মাসে সরকার প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৫৫ ও পাম অয়েল ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। আর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি কেজি ১৬৩ ও পাম অয়েলের দাম নির্ধারণ করে দেয় ১৪০ টাকা। এর বিপরীতে প্রতি কেজি খোলা সরিষা তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকায় আর বোতলজাত সরিষা তেলের কেজি ২০০-৩০০ টাকা। 

পারটেক্স স্টার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজ আল মাহমুদ মিঠু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন, পাম ও সানফ্লাওয়ার তেলের দাম যেহেতু বেড়ে গিয়েছিল, সে কারণে বাংলাদেশের মানুষ সয়াবিন ও পাম থেকে কিছুটা সরে এসেছে। ফলে সরিষা তেলের কিছুটা চাপ বেড়েছে। আবার স্বাদ ও ঘ্রাণের কারণে মানুষ এখন সরিষা তেল রান্নায় ব্যবহার করছে। সার্বিকভাবে সরিষা তেলের চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমাদের ধারণা, সরিষার উৎপাদন ও ভোগ আরো বাড়বে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন