ইজারার শর্ত ভেঙে বালি উত্তোলন

ফেনী নদীর ভাঙনে বিলীন দুই হাজার একর তিন ফসলি জমি

নূর উল্লাহ কায়সার I ফেনী

ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার গোপাল ও শুভপুরে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বছরের পর বছর ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করে ফেনী নদীর বালি উত্তোলন করছেন ইজারাদারা। এতে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার গোপাল ও শুভপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীভাঙনে কমছে ফসলি জমি। এরই মধ্যে দুই হাজার একর তিন ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এখনই বালি উত্তোলন বন্ধ না করলে আগামী মৌসুমেই এসব জমিও তলিয়ে যাবে বলে মনে করেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। তাদের দাবি, বিস্তীর্ণ কৃষিজমি, সরকারি সেচ স্কিমের পাইপলাইন নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ভাঙন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি ও কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চাষযোগ্য জমি কমতে শুরু করেছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জানানো হলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা।

তবে জেলা প্রশাসন বলছে, বিষয়টি তাদের জানা আছে। আগামীতে শুভপুরে কোনো বালুমহাল না রাখতে সুপারিশ করে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে বালি উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছে।

গত ১০ মার্চ ভাঙনকবলিত এলাকার কৃষক ও সাধারণ মানুষ বালি উত্তোলন বন্ধ করে ক্ষতিপূরণ দাবিতে মানববন্ধন করেন। শুভপুর ও গোপাল ইউনিয়নের জয়পুর, লাঙ্গলমোড়া, কাটা পশ্চিম জোয়ার এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, শুভপুর সেতুসংলগ্ন স্থানে দীর্ঘদিন বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। সাত-আট বছর ধরে শক্তিশালী যন্ত্র বসিয়ে বালি উত্তোলন করায় শুভপুর সেতু হুমকির মুখে। আশপাশে ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। একের পর এক ফসলি জমি বিলীন হচ্ছে। এরই মধ্যে দুই হাজার একর তিন ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে প্রায় চার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফসলি জমি কমে আসায় চরাঞ্চলে উৎপাদন কমছে।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মুহুরী সেচ প্রকল্পের স্কিম ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফসল আবাদের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছিল। সেটি বালি উত্তোলনকারীরা তুলে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের একটি পাইপও নদীতে তলিয়ে গেছে।’

জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, ‘শুভপুরে নিয়ম ভঙ্গ করে বালি উত্তোলনের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। বালি উত্তোলনের কারণে আশপাশে নদী ভাঙনসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা শুভপুরে বালুমহাল ইজারা না দিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাওয়া যাবে।’

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রাতের আঁধারে ফসলি জমির পাশ থেকে বালি উত্তোলন করে প্রভাবশালী চক্রটি। বালি উত্তোলনের এক-দুইদিনের মধ্যে আশপাশের ফসলি জমি ভেঙে পড়ে নদীতে। তার পরও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

মফিজুর রহমান নামে এক কৃষক বলেন, ‘বাবার রেখে যাওয়া তিন একর জমিতে চাষ করে সংসার চালাতাম। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতাম। কিন্তু বছর খানেক আগে বালি উত্তোলনের কারণে আমার দুটি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। অবশিষ্ট দুটি জমিও বিলীন হওয়ার পথে। এখন যা উৎপাদন হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। সারা বছরই আত্মীয়স্বজনের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।’

স্থানীয় বাসিন্দা ডা. নুরুল আমিন হেলাল জানান, ২৫ অক্টোবর ক্ষতিগ্রস্ত এনামুল হক, আবুল কালাম, সাজেদুল করিম, দেলোয়ার হোসেন, ফজলুল করিম, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. সুমনসহ এলাকার বেশকিছু ব্যক্তির স্বাক্ষরিতসংবলিত একটি দাবিনামা জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তারকে দেয়া হয়। ওই দাবিনামায় ফসলি জমি রক্ষায় ভূমিদস্যু ও বালি উত্তোলনকারীদের কবল থেকে রক্ষার আবেদন করা হয়। কিন্তু কার্যত কোনো প্রতিকার পাইনি।’

জয়পুর ও লাঙ্গলমোড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ফেনী নদী থেকে বালি উত্তোলনের কারণে জয়পুর, কাটা পশ্চিম জোয়াড়, জয় চাঁদপুর, লাঙ্গলমোড়া এলাকায় ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। বিশেষ করে লাঙ্গলমোড়া, শুভপুর ও জয়পুরে নদীভাঙনে দুই হাজার একর জমি তলিয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও এসব জমিতে বারো মাসই কোনো না কোনো ফসল উৎপাদন হতো। এখনো অবশিষ্ট সবুজ বিস্তীর্ণ জমিতে রয়েছে ডালজাতীয় বিভিন্ন ফসলসহ তরমুজ, মিষ্টি আলু, কুমড়া, ক্ষীরাসহ নানা জাতের ফসল। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন