একসময়ের নিছকই ‘ডেঙ্গু জ্বর’ দিনকে দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। তার প্রমাণ গত বছর বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছি আমরা। সরকারি উপাত্তমতে, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি রোগী। এর মধ্যে মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন। অথচ ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬। এর মধ্যে মারা যায় ৮৫০ জন। পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে যে গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছিল সর্বোচ্চ। এদিকে চলতি বছরের শুরুতে (জানুয়ারি) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৫৫ জন এবং মারা যায় ১৪ জন। এ তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে গত বছর ডেঙ্গুর ভয়াল থাবার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এর প্রতিরোধের কোনো সুব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রতিকারের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি চিকিৎসা খাতকে বেগ পেতে হয়েছে গত বছর। তাই প্রতিকারের মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বা মৃত্যুহার কমানোর প্রশ্নে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যায়। ডেঙ্গু মোকাবেলায় প্রতিরোধ ও প্রতিকারে যত দ্রুত সম্ভব তৎপরতা বাড়াতে হবে।
কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে। একসময় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি ছিল শহরে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে এখনো আক্রান্তদের অধিকাংশই ঢাকার বাসিন্দা। এছাড়া সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুর ধরন ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার মৌসুমেও পরিবর্তন এসেছে। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ দেখা দিত। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সারা বছরই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে। এমনকি ডেঙ্গু মশা শুধু দিনের বেলা কামড়ায় সে ধারণাও এখন ভুলে পরিণত হয়েছে। গবেষণার তথ্য বলছে, এডিস মশা তার চরিত্র পাল্টেছে। এখন দিনে বা রাতে সব বেলাতেই কামড়াতে পারে এডিস এজিপ্টি, বিশেষ করে রাতে যদি ঘর আলোকিত থাকে। ফলে মৌসুমের আগেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন, গত বছরের মতো এ বছরও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে এবং অবস্থার অবনতি ঘটবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগে প্রতি বছর ৪০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। গত বছরের তুলনায় এ বছরের শুরুতেই আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে এ পরিমাণ আরো বহুগুণ বেড়ে দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা চলছে ত্রুটিপূর্ণ নিয়মে। শুধু এডিস মশা নিধন, লার্ভা ধ্বংসের মাধ্যমে এর প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডেঙ্গুর ভাইরাস নিয়েও কাজ করা প্রয়োজন। কেননা এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয় না। যে এডিস মশার ভেতর ডেঙ্গু ভাইরাস থাকে কেবল সেটি কামড়ালেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই ডেঙ্গুর ভাইরাস রোধে কাজ করতে হবে, নয়তো আগামীতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না।
ডেঙ্গু মোকাবেলায় হরহামেশাই গতানুগতিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে দেশে। অবশ্য একসময় এটি কেবলই এক ধরনের জ্বর ছিল। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ওই সাধারণ ডেঙ্গুই এখন প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। তাই আমাদেরও এবার নড়েচড়ে বসা উচিত।
ডেঙ্গুর পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য মোকাবেলা করা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। এজন্য গবেষণা ও নজরদারি জোরদার করতে হবে। আমরা কেবল হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সংখ্যা নিরূপণ করতে পারি। কিন্তু এর বাইরেও অগণিত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং ঘরে বসে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। তাদেরও গবেষণার আওতায় আনতে হবে। ডেঙ্গুর প্রকৃত স্বরূপ ধরতে না পারলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা মুশকিল হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ গড়তে ডেঙ্গুর টিকার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সুখবর হলো, এরই মধ্যে আমাদের একটি টিকা (টিভি০০৫) আবিষ্কৃত হয়ে তৃতীয় ধাপে ছাড়পত্রের অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ছাড়পত্র পেলে দুই বা তিন বছরের মধ্যে এর বাণিজ্যকরণ হবে। কিন্তু তার
আগেও কীভাবে দেশের মানুষকে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়, সে বিষয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্তে আসা উচিত সংশ্লিষ্টদের।
প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো সচেতনতা বৃদ্ধি। যেকোনো বিষয়ের অংশীদার আমরা সবাই—সাধারণ মানুষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাই সর্বস্তরে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড নিশ্চিত করতে হবে ডেঙ্গু মোকাবেলায়। কোথাও যেন অপ্রয়োজনীয় পানি জমতে না পারে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। ড্রেনেজ সিস্টেমকে যথাযথ রাখতে মনোযোগ দেয়া দরকার। সর্বদা মনে রাখতে হবে, এডিস মশার উৎস নির্মূল করাই এর প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। অবশ্য সর্বাপেক্ষা জরুরি পরিকল্পিত নগরায়ণ। অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা যে বর্তমান ভয়াল দশার জন্য দায়ী সে দায় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারবে না। তবে এসবই হলো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনার কথা।
প্রাদুর্ভাব যেহেতু ছড়িয়ে পড়েছে, তাৎক্ষণিক মশা দমনেও দেশজুড়ে বড় ধরনের জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। মশা দমনে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর কার্যকারিতা যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। মশারি, মশানাশক ক্রিমের ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। এর পরও যারা আক্রান্ত হবে তাদের জন্য হাসপাতালে গেটকিপিং ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। যাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই সুস্থ করা সম্ভব তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বেশি ডেঙ্গু রোগী যেন ভর্তি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি রাখতে হবে প্রয়োজনে। যা-ই করা হোক না কেন, সময় খুব কম। ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে তৎপরতা বাড়াতে হবে শিগগিরই।