হার্নিয়া

হার্নিয়ার একমাত্র চিকিৎসা অস্ত্রোপচার

ডা. সৌরভ সুতার

ছবি: সায়েন্স পিকচার করপোরেশন

হার্নিয়া বলতে বোঝায় পেটের মধ্যে যে খাদ্যনালি, খাদ্যনালির ওপরে যে পর্দা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে সেগুলো পেটের যে দেয়াল তার কোনো দুর্বল অংশ থেকে চাপ দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে।

যাদের ঝুঁকি রয়েছে

হার্নিয়া আসলে পুরুষ বা নারী উভয়েরই হতে পারে। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে হার্নিয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। 

হার্নিয়ার কারণ

বেশির ভাগ রোগীর কুঁচকিতে ফুলে যায়। তাদের অভিযোগ থাকে কুঁচকিতে প্রথমে ছোট ফোলা ছিল, ধীর ধীরে তা বড় হচ্ছে। এটাকে ইনগুইনাল হার্নিয়া বলা হয়। এছাড়া এটি নাভির ওপরে হতে পারে, পাশে হতে পারে। যাদের অপারেশন হয়েছে, অপারেশনের পর যে জায়গা দুর্বল হয়ে যায় সেখানে হতে পারে। এছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে অপারেশনের পর যে দুর্বল জায়গাগুলো থাকে সেখানে হয়। অপারেশনের পর দুর্বল জায়গায় যে হার্নিয়া হয় তাকে বলা হয় ইনসিশনাল হার্নিয়া। আরো একটা হার্নিয়া আছে যেটা কুচঁকিতে হয়। সেটাকে বলা ফেমোরাল হার্নিয়া। এটাও নারীদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। বয়স্করা ছাড়াও শিশুদের ক্ষেত্রেও হার্নিয়া হয়। একদম জন্মগতভাবে হার্নিয়া নিয়েই অনেক শিশু জন্মগ্রহণ করে। 

পেটের মধ্যে চাপ বেশি পড়লে হার্নিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন দেখা যায় অনেকের অনেকদিন ধরে কাশি আছে, কারো অ্যাজমা আছে বা হাঁপানি আছে। তারা হাঁচি-কাশি দিলে পেটের মধ্যে চাপ পড়ে। যার কারণে পেটের মধ্যের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ঠেলে বের হওয়ার চেষ্টা করে এবং দুর্বল অংশ থেকে বের হয়ে যায়। কারো যদি প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা থাকে এবং প্রোস্টেড গ্ল্যান্ড যদি বড় হয় তাহলে তাকে প্রেসার দিয়ে প্রস্রাব করতে হয়। তখনো কিন্তু তার পেটের ওপর চাপ পড়ে বা মলত্যাগ করার সময়ও তার প্রচুর চাপ দিতে হয়। তখন তাদের হার্নিয়া হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। আরেকটি ব্যাপার হলো অপারেশন করার পর সে জায়গাটা এমনিতেই দুর্বল হয়ে যায়। যদি সেখানে আবার ইনফেকশন হয়, তাহলে সে স্থান আরো দুর্বল হয়ে যায়। তাহলে সেখানে ইনসিশনাল হার্নিয়া বা অপারেশনের পরবর্তী যে হার্নিয়া সেটা হওয়ার হার বেশি থাকে। 

রোগ নির্ণয় 

শারীরিক পরীক্ষা বা ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন হয়ে থাকে তার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। রোগীরা যেসব লক্ষণ নিয়ে আসে সেগুলো হলো নির্দিষ্ট অংশ ফুলে যাওয়া, ফুলে যাওয়ার সঙ্গে ব্যথা থাকা। হার্নিয়া যখন ফুলে ওঠে তখন তা বোঝা যায়। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় তা শুধু ব্যথা করে। তখন দেখা যায় নাভিতে ফুলে আছে বা এর আশপাশে ফুলে আছে বা অপারেশন যে জায়গায় হয়েছে সে জায়গা ফুলে আছে। তখন নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটি হার্নিয়া। সেক্ষেত্রে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হয় না। তবে তা প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা কিনা বা পেটে টিউমার আছে কিনা তা বোঝার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। কারো যদি অনেকদিন ধরে কাশি থাকে তাহলে বুকের এক্স-রে করা হয়। তবে হার্নিয়া নির্ণয় করার জন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার নেই।

চিকিৎসা

হার্নিয়ার একমাত্র চিকিৎসা অস্ত্রোপচার। অনেকে ওষুধ দিয়ে থাকেন, অপচিকিৎসা করে থাকেন। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হওয়া উচিত। এ রোগের ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ দেয়া হয় না, সরাসরি অপারেশন করা লাগে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কাশি দিলে বা হাঁটাচলা করলে হার্নিয়া বের হয়। আবার শুয়ে থাকলে তা আবার ঠিক হয়ে যায়। তাহলে অপারেশন না করলেও চলে।

রোগী হাঁচি-কাশি দিচ্ছে, দাঁড়াচ্ছে তখন বের হচ্ছে এবং আবার যখন শুয়ে পড়ছে তখন তা ভেতরে চলে যাচ্ছে। এই যে আসা-যাওয়া করছে এটা হলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এর মধ্যে যদি আটকে যায়, সেই আটকে যাওয়াটাকে আমরা বলি অবস্ট্র্যাকশন। এটি হলেও অনেক সময় রোগীর খাদ্যনালির রক্তনালি বন্ধ হয় না। কিন্তু যখন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, এ পর্যায়কে আমরা বলি স্ট্রাঙ্গুয়েশন এবং সেটি যদি ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আটকে থাকে তাহলে কিন্তু খাদ্যনালি গ্যাংগ্রিন হয়ে যায় এবং খাদ্যনালি ছিদ্র হয়ে যায়। এটি মারাত্মক ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে ডাক্তার অনেক সময় পেটের এক পাশে ছিদ্র করে রাখে, মল বের হওয়ার জন্য এবং এটিই আসলে ভয়ের কারণ।

অনেকেই প্রশ্ন করে থাকে হার্নিয়া অপারেশন করবে কিনা। আরো একটি প্রশ্ন থাকে, কারা হার্নিয়ার চিকিৎসা নেবে বা একটি শিশু জন্মগ্রহণ করেছে হার্নিয়া নিয়ে, এত ছোট বাচ্চা সেক্ষেত্রে কী করণীয়। হার্নিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এমন শিশুর ক্ষেত্রে যখনই হার্নিয়া শনাক্ত হয়েছে সেদিনই অপারেশন করে ফেলতে হবে। 

কারণ হার্নিয়ার অনেক ভ্যারাইটি আছে। অনেক বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও হার্নিয়া অপরেশন করে ফেলাই উত্তম। 

হার্নিয়া অপারেশনের পদ্ধতি 

আগে ডাক্তাররা কেটে অপারেশন করতেন। এখন তারা ল্যাপারোস্কপিক বা ছিদ্র করে অপারেশন করে থাকেন। তবে যাদের হার্নিয়া আসা-যাওয়া করে তাদের ডাক্তাররা ল্যাপারোস্কপিক করে থাকে। কিন্তু যে হার্নিয়া আটকে গেছে তাদের ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কপিক করা যায় না। তবে ল্যাপারোস্কপিক বা কেটে যেভাবেই করা হোক না কেন, ডাক্তারদের নেট বা জাল ব্যবহার করতে হয়। 

হার্নিয়া অপারেশনের পর দশমিক ১ শতাংশ রোগীর আশঙ্কা থাকে পুনরায় আবার হার্নিয়া হওয়ার। যাদের অনেক দিন ধরে কাশি থাকে, প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা থাকে, মল শক্ত হয়—এ ধরনের রোগীদের যদি এ সমস্যাগুলোর চিকিৎসা আগে না করা হয় তাহলে হার্নিয়া ফিরে আসার ঝুঁকি অনেক বেশি। যেমন যার হাঁপানি আছে, প্রোস্টেটের সমস্যা আছে, তার চিকিৎসা না করে হার্নিয়ার অপারেশন করা হয়; তাহলে এ ক্ষেত্রে হার্নিয়া ফিরে আসতে পারে। 

সতর্কতা 

ডাক্তাররা এক্ষেত্রে সবসময় জীবনযাত্রার মান নিয়ে কথা বলে থাকেন। যেমন ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ব্যায়াম করা এবং মল স্বাভাবিক রাখতে হলে প্রচুর শাকসবজি খাওয়া, পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করা। কারো যদি কাশির সমস্যা থাকে দীর্ঘদিন তাহলে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নিতে হবে। প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড বা পেটে টিউমার থাকে, সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিলে কিন্তু হার্নিয়া হওয়ার প্রবণতা কম থাকে। কিন্তু যদি হার্নিয়া হয়েই যায় তাহলে তার চিকিৎসা একমাত্র অপারেশন।

লেখক: আবাসিক সার্জন (জেনারেল), শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন