প্রশিক্ষক-শিক্ষাক্রমসহ নানা সংকটে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। এজন্য জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) অধীনে ৬৭টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) স্থাপন করেছে সরকার। যদিও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষকের অভাবে প্রয়োজনমাফিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না পিটিআইগুলো। বাধ্যতামূলক হলেও দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বড় একটি অংশ এখনো রয়ে গেছেন প্রশিক্ষণের বাইরে। এজন্য পিটিআইগুলোর জনবল ঘাটতির পাশাপাশি আবাসন সংকট ও কারিকুলাম-সংক্রান্ত জটিলতাকে দায়ী করছেন তারা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৭টি পিটিআইয়ে মোট প্রশিক্ষকের পদ আছে ১ হাজার ৪১টি। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রশিক্ষক কর্মরত ৬০২ জন। প্রশিক্ষকের পদ ফাঁকা আছে ৪৩৯টি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পিটিআইগুলোয় প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি করা হবে বছরে দুবার। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা নির্ধারিত হবে আবাসন সুবিধা ও প্রশিক্ষক সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। 

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এ-সংক্রান্ত একটি চিঠির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৬৭টি পিটিআইয়ে মোট আসন সংখ্যা ৭ হাজার ১২০। সে অনুযায়ী প্রতি বছর দুই দফায় মোট ১৪ হাজার ২৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। বর্তমানে প্রাথমিকে প্রশিক্ষণহীন শিক্ষক আছেন প্রায় এক লাখ। প্রশিক্ষকের সংখ্যা ও আবাসন সুবিধা না বাড়ালে এ শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে সময় লাগবে আরো প্রায় আট বছর। 

রংপুর পিটিআইয়ের সুপারিনটেনডেন্ট মো. রেজাউল হক এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌শিক্ষার মান নিশ্চিতে শিক্ষকদের ভালোভাবে প্রশিক্ষিত করা সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু আমাদের পিটিআইগুলোয় দীর্ঘদিন ধরেই প্রশিক্ষকের সংকট রয়েছে। প্রশিক্ষণ যাতে ভালো মানের হয়, এ কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তির একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে আগে আমরা যেখানে ১৫০ জন ভর্তি করতাম এখন সেখানে ৯০ জন ভর্তি নেব। কিন্তু এক্ষেত্রে জটিলতা হবে সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সময়সাপেক্ষ হবে। এ কারণে দ্রুত প্রশিক্ষকের সংখ্যা ও আবাসন সক্ষমতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।’

বিভিন্ন পিটিআইয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ৬৫টি পিটিআইয়েই প্রশিক্ষকের সর্বনিম্ন একটি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০টি পর্যন্ত পদ শূন্য রয়েছে। সবচেয়ে কমসংখ্যক প্রশিক্ষক নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে নওগাঁ, মেহেরপুর, চাঁদপুর, কুড়িগ্রাম, ফেনী, বান্দরবান, লক্ষ্মীপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ পিটিআই। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষকের সংখ্যা সাত বা এর কম। প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশিক্ষণার্থী গ্রহণ করছে সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এতে প্রতিটি পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যাও এখন আগের চেয়ে কমছে। 

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২২ অনুযায়ী, বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭০৯। এর মধ্যে প্রশিক্ষিত আছেন ২ লাখ ৬৬ হাজার ৯৬৯ জন। প্রশিক্ষণের বাইরে রয়ে গেছেন ৯৫ হাজার ৭৪০ জন। এছাড়া প্রাথমিকে প্রায় প্রতি বছরই নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ফলে বর্তমান ‍পিটিআইগুলোর সক্ষমতা না বাড়লে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা ক্রমেই আরো চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

এসব প্রতিষ্ঠানে জনবল বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে ঢাকা পিটিআইয়ের সুপারিনটেনডেন্ট মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘‌আমাদের একটি প্রস্তাব ছিল এর সময় ১০ মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করার। কিন্তু আমাদের সব কথা তো রাখা যায় না, সরকারেরও নিজস্ব কিছু পলিসি থাকে। আবার সময়সাপেক্ষ ট্রেনিং হলে শিক্ষক সংকট তৈরি হয়। তাই আমরা চাই পিটিআইগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হোক, যাতে দ্রুত সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়।’

এদিকে শুধু প্রশিক্ষক ও আবাসন সংকটই নয়, জটিলতা রয়েছে শিক্ষাক্রম নিয়েও। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী পিটিআইগুলোয় ১৮ মাসের কোর্স চালু করা হয়েছিল। পরে এটি ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। এ সিদ্ধান্তকে আইনের লঙ্ঘন দাবি করে পিটিআই প্রশিক্ষকদের পক্ষ থেকে আইনি নোটিসও দেয়া হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা ১০ মাসই রাখা হয়। এতে শিক্ষকরা পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণ পাবেন কার্যত ছয় মাস। সময় কমে আসায় শিক্ষাবিদরা আশঙ্কা করছেন, এতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি থেকে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‌শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সময়সীমা অন্তত এক বছর হওয়া উচিত। প্রশিক্ষণের সময়সীমার কথা বললে এর সঙ্গে কয়েকটি দিক জড়িত। এর মধ্যে একটি হলো, যখন আমরা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেব তখন আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একটা সংকট তৈরি হবে এবং আমাদের সব শিক্ষক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে অনেক বেশি সময় চলে যাবে। কিন্তু আরেকটি বিষয় হলো, শিশুদের শেখানো তুলনামূলক কঠিন কাজ। আর আমাদের দেশে যারা শিক্ষকতায় আসেন তাদের বড় অংশ শিক্ষকতা নিয়ে ধারণা না নিয়েই আসেন। ফলে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণে তারা যে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত হবেন এটি বলা কঠিন, বরং প্রশিক্ষণে ঘাটতি থেকে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই প্রশিক্ষণের সময়মীমা অন্তত এক বছর হলে ভালো হতো।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌শিক্ষাসংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোয়, বিশেষ করে শিক্ষকদের পদ শূন্য থাকা কখনই কাম্য নয়। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে ইনস্ট্রাক্টরদের সংকট অবশ্যই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরসন করতে হবে। সরকারের উচিত প্রয়োজনে এ সংকট দূর করতে বিশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করা, যেখানে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেড়-দুই মাসের মধ্যে পদগুলোয় নিয়োগ দেয়া হবে।’

পিটিআই প্রশিক্ষকদের তথ্য অনুযায়ী, শুরুতে এ কোর্সের মেয়াদ ছিল এক বছর। জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১২-এ তা দেড় বছর করা হয়। শুরুতে সাতটি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত পিটিআইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে দেড় বছর মেয়াদি কোর্স চালু করা হয়। পরে ২০১৯ সালে এ মেয়াদের শিক্ষাক্রম সবক’টি পিটিআইয়ে একযোগে চালু হয়। যদিও এক পর্যায়ে অভিযোগ ওঠে, এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকের সংকট দেখা দিয়েছে। আবার বিষয়টি বেশ সময়সাপেক্ষও। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমিয়ে ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ছয় মাস প্রশিক্ষণ হবে পিটিআইয়ে এবং বাকি চার মাস প্র্যাকটিস টিচিংয়ে। এ চার মাসের প্রশিক্ষণকাজটি হবে মূলত বিদ্যালয়ে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নেপের পরিচালক জিয়া আহমেদ সুমন বলেন, ‘‌কারিকুলামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমরা নিই না। এটি মন্ত্রণালয় থেকে নেয়া হয় এবং আমরা সে অনুযায়ী কাজ করি। তবে ১০ মাসের সিদ্ধান্ত যেহেতু নেয়া হয়েছে, নিশ্চয়ই সব দিক বিবেচনা করেই নেয়া হয়েছে। আশা করি, এতে কোনো সমস্যা হবে না।’

বর্তমানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-৪ (পিইডিপি-৪) চলমান রয়েছে। প্রকল্পের অতিরিক্ত মহাপরিচালক দিলীপ কুমার বণিক বলেন, ‘‌মূলত প্রশিক্ষকের নিয়োগ পিএসসির অধীনে থাকায় এতে সময় বেশি চলে যাচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এ সংকট কমিয়ে আনার। সম্প্রতি ১১৯ জন প্রশিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন