সালমান এফ রহমান ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ডোনাল্ড লুর বৈঠক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডোনাল্ড লুকে গতকাল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাগত জানানো হয় ছবি: মার্কিন দূতাবাস

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ডোনাল্ড লু তিনদিনের ঢাকা সফরের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রীর সেরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রাজধানীর গুলশানে সালমান এফ রহমানের বাসায় গতকাল রাতে এ বৈঠক অনুষ্ঠত হয়। তার আগে বিকালে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ডোনাল্ড লু। 

বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার বিষয়ে সাংবাদিকদের বিস্তারিত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘বৈঠকে উনারা বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায়। আমরা চাই বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করতে। তখন আমরা বলেছি—হ্যাঁ, আমরাও চাই।’

নির্বাচনের আগে ও পরেও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে কিছু ইস্যু ছিল জানিয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেন। সেটা খুবই ইতিবাচক একটা চিঠি ছিল। তার পর থেকে আমরা তাদের সঙ্গে অ্যাংগেজমেন্ট শুরু করে দিলাম। সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথমত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। এছাড়া তারা বিদ্যুৎ খাত নিয়েও কাজ করতে চায়। ভুটান, নেপাল ও ভারতের সঙ্গে আমাদের বিদ্যুতের একটা আন্তঃযোগাযোগ চায়। আমরা ভারতসহ এ দেশগুলোর সঙ্গে কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছি, এটা জেনে তারা খুশি হয়েছে।’ 

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান সালমান এফ রহমান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য যথারীতি তারা ধন্যবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে যতটুকু সাপোর্ট দেয়া যায় সেটি দেবে বলে জানিয়েছে তারা। আমরা বলেছি রোহিঙ্গাদের যাতে ফেরত নেয় সে জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তারা বলেছে, আমরা চেষ্টা করছি। আবার এটাও বলেছে, মিয়ানমারের এখন যে অবস্থা তাতে প্রত্যাবাসনে সময় লাগবে।’

ভিসানীতি এবং র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘ভিসানীতি নিয়ে কোনো আলাপ হয়নি। তারাও কথা তোলেনি, আমরাও না। এখন তো মনে হচ্ছে ভিসা নিষেধাজ্ঞা বিএনপির ওপর দেয়া উচিত। তবে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আমরা তুলেছি। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরত দেয়ার বিষয়েও কথা বলেছি। তখন তারা বলেছে, এ দুটা বিষয় তাদের বিচার বিভাগের বিষয়। তারা বিচার বিভাগকে জানিয়েছে যে আমাদের র‍্যাবের বিষয়গুলোর উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এটার একটা প্রক্রিয়া রয়েছে, সে অনুযায়ী তারা কার্যক্রম এগিয়ে নেবে।’

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে আমাদের কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে তারা বলেছেন, তোমরা যদি আইএলওর নীতিমালা অনুযায়ী শ্রমনীতি তৈরি কর, আইএলও থেকে যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমাদেরও কোনো আপত্তি নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও আইএলও দুপক্ষেরই নিয়মনীতি এখন এক। একটা সময় কিছুটা আলাদা ছিল কিন্তু এখন আর সেটা নেই। আমরা খুব আশাবাদী যে আইএলওর সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয়ে যাবে। হয়ে গেলে আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা কোনো আপত্তি থাকবে না বলে তারা জানিয়েছে।’ 

এর আগে বিকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গুলশানের বাসায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ডোনাল্ড লু। সেখানে গণমাধ্যমকর্মী, মানবাধিকার, শ্রমিক নেতা ও জলবায়ুকর্মীরা অংশ নেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, মতিবিনিময় সভায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পাশাপাশি অর্থনীতি, শ্রম অধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়েও ডোনাল্ড লু জানতে চান। আলোচনায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পরবর্তী সময়ে প্রণয়ন করা সাইবার নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গও সামনে আসে। 

ডোনাল্ড লু নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাছে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও জানতে চান। বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন, নাগরিক সমাজ কোন অবস্থায় কাজ করছে ইত্যাদি। তখন ডোনাল্ড লুকে জানানো হয়, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্র সামগ্রিকভাবে সংকুচিত হয়েছে। এ পর্যায়ে লু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছিল। নির্বাচন হয়ে গেছে, সরকার তার মতো করে কাজও করছে। এমন পরিস্থিতিতে এমন চাপ কেন, এমনটা তারা আশা করেননি। এটা উদ্বেগের।

নাগরিক সমাজের আলোচনায় ফিলিস্তিন পরিস্থিতিও গুরুত্ব পেয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে তিনি মত জানতে চান। এ সময় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ফিলিস্তিন পরিস্থিতি, বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভ দমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করেন।

মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম, বাংলাদেশ সেন্টার ফর উইমেন ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার, মানবাধিকারকর্মী মো. নুর খান, চাকমা সার্কেলের রানি ও মানবাধিকারকর্মী ইয়ান ইয়ান, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্দোলনের সংগঠক সোহানুর রহমান এবং তরুণ সংগঠক মাহমুদা আক্তার মনীষা।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ডোনাল্ড লুর পাশাপাশি আরো উপস্থিত ছিলেন ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের চিফ অফিস স্টাফ ন্যাথানিয়াল হাফট, ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্ট অ্যান্ড রিসার্চের বিশ্লেষক সারাহ আল্ডরিচ, পিটার হাস, ইউএসএআইডির মিশন ডিরেক্টর রিড এসলিম্যান, পলিটিক্যাল কাউন্সিলর আর্তুরো হাইনস, ডেপুটি পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কাউন্সিল শ্যারন ফিটজগ্যারল্ড, পলিটিক্যাল অ্যাটাচ ম্যাথিউ বেহ। এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত আছিম ট্রোস্টারও ছিলেন।

মতবিনিময় সভা শেষে বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জলবায়ুকর্মী সোহানুর রহমান জানান, ডোনাল্ড লুর সঙ্গে নাগরিক সমাজের আলোচনায় স্থান পেয়েছে জলবায়ু অভিযোজন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সুরক্ষার বার্তা দিয়েছেন তিনি। অ্যাক্টিভিজমের পাশাপাশি উপকূলীয় মানুষের সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, অর্থনৈতিক, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এর আগে ডোনাল্ড লু আজ দুপু‌রে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম। সফরের দ্বিতীয় দিন আজ বুধবার ডোনাল্ড লুর প্রথমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে এবং পরে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করার কথা রয়েছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন