আলোকপাত

বন্ধ ঘোষিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করা হোক

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

গত ১১ সেপ্টেম্বর বণিক বার্তার এক খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন বন্ধ ঘোষিত ২৬টি পাটকলের মধ্যে অন্তত ১০টি সরকারিভাবে পুনরায় চালু করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পাটচাষী ও পাট ব্যবসায়ী সমিতি। সমিতির পক্ষে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘দেশে পাট ও পাটসংশ্লিষ্ট পণ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি লোক সম্পৃক্ত। ২০২০ সালের ১ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিজেএমসির অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর শ্রমিকরা কলোনি ছেড়ে যেতে বাধ্য হন, বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। কথা ছিল লে-অফ অর্থাৎ তিন মাস পর আবার চালু করবেন। কিন্তু আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর পার হলেও এখনো কোনো মিল চালু হয়নি। সরকার বিভিন্নভাবে ব্যক্তিমালিকানায় লিজ দিয়েও চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিছু কিছু কারখানা লিজ নিয়েও উৎপাদনে যেতে পারছে না। অনেক মিল এখন পর্যন্ত লিজ দেয়া হয়নি। ফলে মিলের যন্ত্রাংশ অকেজো হয়ে যাচ্ছে।’ বন্ধ থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সরকারি বা বেসরকারি কিংবা উভয় খাতে কেন দ্রুত চালু করা দরকার মূলত তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। 

বর্তমানে যে ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত, সেখানে প্রাচীনকাল থেকে পাটের চাষ হয়ে আসছে। তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব এগ্রিকালচার কর্তৃক যৌথভাবে সম্পাদিত ‘Agricultural Research in Bangladesh in the 20th century’ শীর্ষক গ্রন্থ অনুযায়ী প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে পাটের চাষ হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পাট চাষের বিস্তার শুরু হয়। ১৮৪০ সালে শুরু হয় ব্যাপকভাবে পাট উৎপাদন। যেসব অঞ্চলে পাট চাষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেগুলো হলো রংপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, বগুড়া, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও নোয়াখালী। বর্তমানে বাংলাদেশের সব জেলায়ই কমবেশি পাট উৎপাদন হয়ে থাকে। পাট চাষ, পাটজাত সামগ্রী তৈরি, পাট ও পাটজাত পণ্যাদির ব্যবসা-বাণিজ্য বহুকাল ধরে এ দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

স্বাধীনতার প্রাক্কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ পাটকলের মালিক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা। এক তথ্য মোতাবেক, পাট শিল্পে মোট তাঁতের আনুমানিক ৬৮ শতাংশের মালিক ছিলেন তারা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি পাটকল মালিকরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় এসব পাটকল রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। বেসরকারি খাতে পাট ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া হয়। অভ্যন্তরীণভাবে পাট কেনা ও পাটপণ্য উৎপাদনের একচেটিয়া দায়িত্ব বর্তায় ৮২টি পাটকল নিয়ে নবগঠিত সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ওপর। পাট রফতানির একচেটিয়া দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ পাট রফতানি সংস্থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে অনভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের এসব পাটকলের ব্যবস্থাপনা, পাটজাত পণ্য উৎপাদন, পাট রফতানির দায়িত্ব প্রদান, দুর্নীতি, মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব, শ্রমিক অসন্তোষ, পলিপ্রোপাইলিন নামক কৃত্রিম তন্তুর আবির্ভাব, কয়েকটি দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি কারণে পাট শিল্পে বিপর্যয় দেখা দেয়। এসব কারণে ’৭৫-পরবর্তী সরকার পাটকলগুলোর বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে, যা পরবর্তীকালে অব্যাহত থাকে। 

আশির দশকে বেসরকারি খাতে পাটকল স্থাপন শুরু হয় এবং দ্রুত এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮২ সালে ৩৫টি বেসরকারি পাটকল নিয়ে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) গঠন হয়। ২০১৯ সালে এ সংস্থার অন্তর্ভুক্ত পাটকলের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া ১৯৭৯ সালে গঠিত বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) আওতায় রয়েছে শতাধিক পাট সুতাকল। সরকারি তথ্য মোতাবেক ক্রমাগত লোকসানের অভিযোগে ২০২০ সালের ১ জুলাই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার আগে সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনাশিপের (পিপিপির) মাধ্যমে সেগুলো চালু রাখার কথা বলে। পরে সরকার এ অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে লিজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারি সূত্রে জানা যায়, অবসানকৃত ও অবসরকৃত শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবে মোট পাওনার ৫০ শতাংশ হিসেবে ১৭৫৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা নগদে পরিশোধ করা হয় এবং অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ অর্থ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় পরিশোধের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বন্ধ ঘোষিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মধ্য থেকে ১৭টি লিজে দেয়ার জন্য আগ্রহীদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করে বিজেএমসি। এগুলো হচ্ছে—চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাফিজ জুট মিলস, গুল আহমেদ জুট মিলস, কেএফডি জুট মিলস, এমএম জুট মিলস, আরআর জুট মিলস; ঢাকা অঞ্চলের ইউএমসি জুট মিলস, বাংলাদেশ জুট মিলস, রাজশাহী জুট মিলস, জাতীয় জুট মিলস এবং খুলনা অঞ্চলের প্লাটিনাম জুবেলি জুট মিলস, ক্রিসেন্ট জুট মিলস, ইস্টার্ন জুট মিলস, খালিশপুর জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, স্টার জুট মিলস, যশোর জুট মিলস ও কার্পেটিং জুট মিলস। ১৪টি পাটকলের জন্য ৫১টি দরপত্র পড়েছে, যেগুলো পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। 

এখন দেখা যাক, বন্ধ ঘোষিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সরকারি বা বেসরকারি কিংবা উভয় খাতে দ্রুত চালু করা কেন জরুরি হয়ে পড়েছে। এক. রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করায় এবং উৎপাদনে না থাকায় দেশে কাঁচা পাটের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে কৃষক পর্যায়ে কাঁচা পাটের দাম হ্রাস পেয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পাটের দাম হ্রাসে পাটচাষীরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। মৌসুমের শুরুতে দামে তেজি ভাব থাকলেও অল্পদিনের ব্যবধানে দরপতনে কৃষকরা হতবাক। পানির দরে পাট বিক্রি করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন। তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। অন্যদিকে এমন পরিস্থিতিতে মধ্যস্বত্বভোগী পাইকার ও ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো অবস্থা। সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা পাট মজুদের মহোৎসবে মেতেছেন। ২ সেপ্টেম্বর বণিক বার্তার খবরে বলা হয়েছে, গত বছর যখন এক মণ পাট বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা, এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায়। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় মণপ্রতি দাম কমেছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা। এতে বাজারে পাট বিক্রি করে পাটচাষীরা আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এমন আর্থিক ক্ষতি কৃষকদের পাট চাষে অনাগ্রহী করে তুলতে পারে। 

দুই. রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার আগে সরকারি-বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে পাট কেনা হতো। এক তথ্যে জানা যায়, বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলগুলোয় ব্যবহারের জন্য ১৮২টি কেন্দ্রের মাধ্যমে পাট কেনা হতো। বিজেএমসি ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি মোট ৬১ হাজার ২২৩ টন কাঁচা পাট ক্রয় করে। এখন বিজেএমসি বাজারে না থাকায় শুধু বেসরকারি পাটকলগুলো বাজার থেকে পাট কিনছে। এসব পাটকলকে পাট সরবরাহকারী মধ্যস্বত্বভোগী পাইকার ও ব্যবসায়ীরা স্থানীয় পর্যায়ে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে পাটচাষীদের কাছ থেকে কম দামে পাট কিনছে বলে মিডিয়ায় অভিযোগ উঠেছে।

তিন. বন্ধ ঘোষণার আগে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোয় হেসিয়ান, স্যাকিং, কার্পেট ব্যাকিং, ক্লথ, উন্নতমানের রফতানিযোগ্য পাটের সুতা, জিও জুট, কটন ব্যাগ, নার্সারি পট, ফাইল কভার ইত্যাদি পাটপণ্য উৎপাদন হতো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০-এর তথ্য মোতাবেক বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলগুলোয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ছিল ৭২ হাজার ১০ টন। পাট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিজেএমসি, বিজেএমএ ও বিজেএসএ সম্মিলিতভাবে ১ হাজার ৭৩০ দশমিক ৪০ কোটি টাকার পাটপণ্য রফতানি করে।

চার. গত ৩১ জানুয়ারি সমকালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন বন্ধ পাটকলে অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে পাঁচ হাজার তাঁত ও অন্যান্য যন্ত্র। রক্ষণাবেক্ষণে মাঝেমধ্যে দায়সারাভাবে যন্ত্রগুলো চালু করা হলেও এ খাতে নেই পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। এতে পাটকলগুলো ফের চালু করা হলে একই যন্ত্র দিয়ে উৎপাদনে যেতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বন্ধ ঘোষিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সরকারি বা বেসরকারি কিংবা উভয় খাতে দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করা গেলে অন্য যেসব সুফল পাওয়া যাবে সেগুলো হলো—ক. কাঁচা পাটের চাহিদা বেড়ে যাবে, যা কৃষক পর্যায়ে পাটের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে সহায়ক হবে। খ. পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বেড়ে যাবে, যা রফতানি আয় আরো বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। গ. বন্ধ ঘোষিত পাটকলগুলোর জমি, কারখানা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সুতরাং এসব পাটকল সরকারি বা বেসরকারি কিংবা উভয় খাতে দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করা গেলে তাঁত ও যন্ত্রাংশগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। 

এছাড়া পাট ও পাট শিল্পের উন্নয়নে কিছু স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাগুলো হলো—১. কৃষক পর্যায়ে পাট চাষে ব্যয় কমাতে সরকার থেকে যথোপযুক্ত প্রণোদনা প্রদান। ২. সিন্ডিকেশনের হাত থেকে পাটচাষীদের রক্ষার্থে স্থানীয় বাজার পর্যায়ে বিভিন্ন মানের কাঁচা পাটের দাম সরকার কর্তৃক এমনভাবে বেঁধে দেয়া, যাতে উৎপাদন ব্যয় মেটানোর পরও পাটচাষীরা লাভবান হন। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে পাটের একর বা হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা চীন ও ভারতের পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাটের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে উৎপাদন ব্যয় কমবে, যা পাটচাষী এবং পাটকল উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক হবে। 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন