পর্যালোচনা

বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বরাদ্দ: ঘাটতি ও সম্ভাবনা

ওমর রাদ চৌধুরী , মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান

বাংলাদেশের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। কিন্তু ২০২০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে উৎপাদন করার পূর্ববর্তী যে লক্ষ্য ছিল, তা থেকে আমরা এখনো যোজন দূরে আছি। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত মোট জ্বালানির মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ আসছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে। ২০৪১ সালের মধ্যে নির্ধারিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩১ সাল ও ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা হতে হবে যথাক্রমে ১৬ ও ৪০ গিগাওয়াট।

মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান: ডিকেড ২০৩০-এর মধ্যে তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প রূপায়ণ করা হয়েছে এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কতটুকু নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস হতে আসবে সে প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রাক্কলন পেশ করেছে। এ দৃশ্যকল্পগুলো হলো, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান-ম্যাক্সিমাল (এমসিপিপি-এম), মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান-রিয়ালিস্টিক (এমসিপিপি-আর) এবং ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) দৃশ্যকল্প। ওই প্রাক্কলন মোতাবেক অনুমিত নবায়নযোগ্য জ্বালানির সর্বোচ্চ অনুপাত হচ্ছে এমসিপিপি-এম দৃশ্যকল্পে, তারপর এমসিপিপি-আর এবং সর্বশেষ এমসিপিপি-এনডিসি দৃশ্যকল্পে, অনুপাতগুলো যথাক্রমে ১৯, ১৩ ও ৬ শতাংশ। প্রত্যিটি দৃশ্যকল্পেই আমাদের বিনিয়োগের প্রয়োজন বিবেচনায় রাখতে হবে। মুজিব ক্লাইমেট প্ল্যানে ওই তিন দৃশ্যকল্পে যথাক্রমে ২০২৫ ও ২০৩০ সালের জন্য দরকারি বিনিয়োগের প্রাক্কলন প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাক্কলন মোতাবেক এমসিপিপি-এম দৃশ্যকল্পে ২০২৫ ও ২০৩০ সালে বিনিয়োগ দরকার হবে যথাক্রমে ২৬ হাজার ৬৭৫ কোটি ও ৬৯ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা; এমসিপিপি-আর দৃশ্যকল্পে ২০২৫ ও ২০৩০ সালে বিনিয়োগ দরকার হবে যথাক্রমে ২১ হাজার ১৯৩ কোটি ও ৪৪ হাজার ২ কোটি টাকা; আর এনডিসি দৃশ্যকল্পে ২০২৫ ও ২০৩০ সালে বিনিয়োগ দরকার হবে যথাক্রমে ৮ হাজার ৮১৯ কোটি ও ১৮ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য (MoPEMR) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগের ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ৩৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছে উন্নয়ন বরাদ্দ হিসেবে। অন্যদিকে জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ বিভাগের (ইএমআরডি) জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৯৯৪ কোটি টাকা, যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মোট বরাদ্দের মাত্র ৩ শতাংশ। উপরন্তু, গত অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে তুলনা করতে গেলে ইএমআরডির বরাদ্দ কমেছে ৪৮ শতাংশ।

লক্ষণীয় যে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ঘোষিত জাতীয় বাজেটেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো প্রণোদনা রাখা হয়নি। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিতে ১৫ দশমিক ১৫ থেকে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ আমদানি শুল্ক ধার্য করে রাখা হয়েছে। অবশ্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ইডকলের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুতে ব্যবহৃত ৬০ অ্যাম্পিয়ার ব্যাটারির ওপর ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। 

বাজেটের বরাদ্দ নিয়ে আলোচনায় দৃষ্টিপাত করলে প্রতীয়মান হয় যে বিভিন্ন জাতীয় পরিকল্পনায় ঘোষিত নবায়নযোগ্য জ্বালানির আনুষ্ঠানিক লক্ষ্যমাত্রা এবং জাতীয় বাজেটে গৃহীত নীতিমালার মধ্যে দৃশ্যমান অসামঞ্জস্য রয়েছে। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানির অগ্রগতি বেগবান করতে দরকারি বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ খাতের অংশগ্রহণ জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ উদ্যোগের প্রয়োজনকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের শুরু থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বৈশ্বিক পর্যায়ে সরকারি ব্যয় বেড়েছে ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার, যা আসলে বোধগম্যও বটে, যেহেতু বৈশ্বিক জ্বালানির জোগানে যে আকস্মিক ব্যত্যয় ঘটছে তার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত দেশগুলোকে টেকসই বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এ বিনিয়োগের বেশির ভাগই হয়েছে উন্নত দেশে এবং সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও উচিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে তার নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা। এক্ষেত্রে একটা বড় কৌশল হলো, ওই খাতে সরকারি বিনিয়োগ ও ব্যয় বাড়ানো, আর সেজন্য বাজেটের বরাদ্দকে পুনর্বিবেচনা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। 

তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত সমস্যা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী দৃষ্টিভঙ্গি হলো, নীতিনির্ধারকরা কোনো একটা নির্দিষ্ট ফার্ম বা প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে তাকে বাজারে বাড়তি সুবিধা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এ ধরনের চর্চা বাজারের কার্য পরিচালনার স্বাভাবিক ধারার বিকৃতি সাধন করতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয় হলো, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সরকারি ভর্তুকি কিছু নির্দিষ্ট অংশীদারের মধ্যে সুযোগসন্ধানী (রেন্ট সিকিং) মনোভাবের জন্ম দিতে পারে। তথাপি সরকারি বিনিয়োগের পক্ষে বেশকিছু যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, পর্যাপ্ত সরকারি বিনিয়োগ তৎপরতা না থাকলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত কেন্দ্র করে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে না, যার ফলে তারা এ খাতকে লাভজনক বিবেচনা করবে না। এক্ষেত্রে সরকারকে হাল ধরার কাজ করতে হবে এবং সরকারি বিনিয়োগের সাহায্যে এ সমস্যার উত্তরণ সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি সাধনে বিনিয়োগকৃত পুঁজির প্রাথমিক উচ্চ ব্যয় এবং সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি গ্রহণে সরকারই অধিকতর সক্ষম। বলা বাহুল্য, এ প্রক্রিয়ায় অবশ্যই সরকারকে এমন পদ্ধতি এবং নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে যেন কোনো স্বার্থান্বেষী মহল অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। 

সামাজিক স্বার্থ এবং সহজাত বাজার গতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ও ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন এখন সময়-সংগত দাবি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ড্যানি রড্রিক তার পরিবেশবান্ধব শিল্প নীতিমালাবিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রদান এবং জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত কর ব্যবস্থা তদারকি ও বাস্তবায়নে ব্যর্থতার মানে হলো, বেসরকারি খাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের রিটার্ন, তার সোশ্যাল রিটার্নের চেয়ে অনেক কম। শিল্প নীতিমালার একটা বৃহৎ কাঠামোর মধ্যে এ ধরনের ভর্তুকি প্রকল্পের সদ্ব্যবহার করতে হলে অধ্যাপক রড্রিকের মতে, সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতায় যাওয়া, যাতে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতাগুলো খুঁজে বের করা ও সমাধান করা যায়। তিনি আরো বলেন, জবাবদিহিতা ও কার্যকরী শৃঙ্খলা বলবৎ করার মাধ্যমে সুযোগসন্ধানী (রেন্ট সিকিং) আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি বিবেচনা করলে বাংলাদেশের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথনির্দেশনা দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করা অপরিহার্য। সরকারের বিবৃত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সাফল্য এবং তার জলবায়ু প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে বিচক্ষণ বাজেট প্রণয়ন ও আর্থিক বণ্টন ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। 

ওমর রাদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান: গবেষণা সহযোগী, সানেম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন