পোশাকের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী, রফতানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দুই অংকের

বদরুল আলম

কভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে ক্রমেই বাড়ছিল বাংলাদেশের পোশাক রফতানি। এর মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় তার প্রভাব পড়ে পুরো বিশ্বে। ফলে সব দেশকেই গত বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। কমে যায় পোশাকের ক্রয়াদেশ। বর্তমানে বড় বাজারগুলোর মূল্যস্ফীতির চিত্র বদলাতে শুরু করলেও ভোক্তাদের ক্রয়াভ্যাস ও ক্রেতাদের ক্রয়াদেশে তেমন কোনো পরিবর্তনের আভাস মিলছে না। এ পরিস্থিতির প্রতিফলন হিসেবে পোশাকের নিম্নমুখী উৎপাদন প্রবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উৎপাদনবিষয়ক সরকারি পরিসংখ্যানে। যদিও পোশাকপণ্য রফতানির লক্ষ্য নির্ধারণে নেই বাস্তবতার প্রতিফলন। এমন পরিস্থিতিতেও চলমান অর্থবছর শেষে রফতানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে দুই অংকের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নিয়মিতভাবে শিল্প উৎপাদনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়েছে প্রথম তিন মাসের পরিসংখ্যান। এতে দেখা যাচ্ছে, দেশের বৃহৎ এ শিল্প খাতের কারখানাগুলোয় জানুয়ারিতে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অংকের ঘরে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পোশাক উৎপাদন বেড়েছে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, অর্থমূল্যে যার পরিমাণ ৪২ হাজার ৮৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধির হার এক লাফে নেমে আসে তার অর্ধেকে। ২০২২ সালের একই মাসের চেয়ে কেবল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে গত ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদন হয়েছে ৩৫ হাজার ৫১৪ কোটি ২০ লাখ টাকার পোশাক। মার্চে এসে পোশাক উৎপাদন কমেছে। প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। বছরের এ তৃতীয় মাসে মোট পণ্য উৎপাদনের অর্থমূল্য ছিল ৩৪ হাজার ৯১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

পোশাক উৎপাদনকারী শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারের চলমান পরিস্থিতিতে পণ্য রফতানি নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক—দুদিকেই বাংলাদেশকে বিদ্যমান প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে পোশাক উৎপাদনের অর্থমূল্যে। এখন দেশের অনেক বড় পোশাক কারখানাও উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারছে না। সব মিলিয়ে চলতি বছরের শুরুতে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি হলেও মার্চে তা কমে গিয়ে ঋণাত্মক হয়েছে। 

এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পোশাকের প্রধান বাজারে রফতানির নেতিবাচক ধারা রয়েছে। কারণ প্রধান দুই বাজারে ভোক্তাদের ক্রয়চর্চায় বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কম দিচ্ছেন। আমাদের অপ্রচলিত বাজারগুলোয় রফতানি বাড়ছে। কিন্তু মোট রফতানিতে এসব বাজারের অবদান তেমন উল্লেখযোগ্য না। আর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলেও ক্রয়াদেশে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।’ 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চলমান অর্থবছরের রফতানি লক্ষ্য নির্ধারণের সভা বসে গতকাল। আলোচনা শেষে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ খাতের প্রধান পণ্য পোশাক রফতানির লক্ষ্য ৫ হাজার ২১০ কোটি ডলারের। পোশাকপণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। 

ইতিবাচক ধারায় ফেরার প্রত্যাশা করলেও পোশাকের বড় বাজারগুলোয় রফতানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ধারায় থাকায় দুশ্চিন্তা কাটছে না রফতানিকারকদের। পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে এখনো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। সমাপ্ত অর্থবছরে দেশ দুটিতে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৫১ ও ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। এ পরিস্থিতির মধ্যেও চলমান অর্থবছর শেষে পোশাক রফতানিতে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাকে বাস্তবসম্মত মনে করছেন না সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও রফতানিকারকরা।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যে পরিস্থিতি তাতে নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা খুব কম। দুই অংকের প্রবৃদ্ধি খুব জটিল হবে। রফতানিতে আমাদের প্রধান পণ্য নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দুদিকেই আমাদের বিদ্যমান প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করাটা অনেক কঠিন হবে। শুধু আমরা না, সারা বিশ্বেই প্রবৃদ্ধি যে হবে সে রকম পরিস্থিতি আমরা দেখছি না। বরং আমাদের চেয়ে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর রফতানিও অনেক কম হবে। সব মিলিয়ে নতুন অর্থবছরে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা এখনো নেই। তবে আমাদের প্রবৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে, যদি অভ্যন্তরীণ সংকট সমাধান করা যায়। এসব সংকটের মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ব্যাংকিং ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডবিষয়ক।’ 

পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বিজিএমইএর প্রতিনিধিরা বলছেন, বাস্তবসম্মত না হওয়ায় চলমান অর্থবছরের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ যে অর্থমূল্যের রফতানি করেছে, চলমান অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দূরের কথা, বরং রফতানি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তাই মারাত্মক দুশ্চিন্তায় এ খাতের উদ্যোক্তারা। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের নীতিসহায়তা নিশ্চিত করা গেলে অন্তত টিকে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হবে। 

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দায় পোশাকপণ্যের ক্রয়াদেশ আমাদের কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না, বরং গত অর্থবছরে যে রফতানি হয়েছে তার চেয়ে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি চলতি বছরের শেষ নাগাদ শ্রম মজুরিও বাড়বে। এর সঙ্গে রয়েছে কাস্টমস, বন্ড, ভ্যাটের হয়রানি। এগুলোর যদি সমাধান হয় তাহলে রফতানি বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এগুলো আমাদের দাবি বা চাহিদা নয়, বরং প্রয়োজন। ফলে এগুলো ছাড়া প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন