সরকারিভাবে বোরো সংগ্রহে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ

কৃষকের অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগ নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী

নূর আহমদ, এইচ আলিম

সরকারিভাবে এবার ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয় ৭ মে। চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

সরকারিভাবে বোরো মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে ১০ দিন আগে। এর মধ্যে অনেক কৃষক অভিযোগ করেছেন, কৃষি কার্ড থাকার পরও তারা সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রি করতে পারছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক পাইকার ও মধ্যস্বত্বভোগী সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে কম টাকায় কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কিনে নিচ্ছেন। বিশেষ করে আর্থিক অনটনে থাকা অনেক কৃষক ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সরকারিভাবে এবার ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয় ৭ মে। শেষ হবে ৩১ আগস্ট। এবার পাঁচ লাখ টন ধান, ১১ লাখ টন সেদ্ধ চাল, এক লাখ টন আতপ চাল ও ৫০ হাজার টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কেজি বোরো ধানের দাম ধরা হয়েছে ৩২ টাকা, সেদ্ধ চাল ৪৫, আতপ চাল ৪৪ ও গম ৩৪ টাকা। 

সিলেট বিভাগের হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায় বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ২৯ হাজার ৮১১ টন বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু ১০ দিন পার হয়ে গেলেও বেশির ভাগ কৃষক ফসল বিক্রি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। 

কৃষকরা বলছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অথবা গ্রামে গ্রামে গিয়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকের কাছ থেকে কৃষি কার্ড সংগ্রহ করার কথা, কিন্তু এ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। 

মঙ্গলবার শাল্লা উপজেলার সাতপাড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দাদন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত দুই ব্যক্তির লোকজন বিশাল নৌকায় বস্তাভর্তি ধান তুলছে। 

এ ব্যাপারে স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছর চৈত্র মাসে অনেক কৃষকের পকেট শূন্য থাকে। এ সুযোগে অনেক পাইকার ও মজুদদার ৭০০-৮০০ টাকা মণ দরে ধান কিনে নেন। এখন নৌকায় সেই ধান নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 

কার্তিকপুর গ্রামের কৃষক উমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের এলাকা থেকে মজুদদাররা চৈত্র মাসে অল্প দামে ধান কিনে নেন। এ সময় কৃষকের হাতে টাকা-পয়সা খুব একটা থাকে না। কৃষি শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ, কৃষি সরঞ্জাম কেনা, মাড়াই ও ধান কাটা যন্ত্রের টাকা পরিশোধসহ নানা কারণে অনেক কৃষক অল্প দামে ধান বিক্রি করে দেন। এ ব্যাপারে প্রশাসনও উদাসীন। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন না।’

সরকারের ধান-চাল কেনার অভিযানে সমন্বয়হীনতার অভিযোগও তুলেছেন অনেকে। শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক নৃপেশ দাস বলেন, ‘আমরা সরকারকে সবসময়ই ধান দিতে চাই, কিন্তু কৃষি কর্মকর্তারা আমাদের কাছ থেকে কার্ড সংগ্রহ করেন না। আমাদের ওয়ার্ডে কে দায়িত্ব পালন করেন, তাও জানি না। অনেক গরিব কৃষক আগেই মহাজনের কাছে অল্প দামে ফসল বিক্রি করে দিয়েছেন।’

শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, ‘ছোট-বড় অনেক মজুদদার চৈত্র মাসেই অল্প দামে আগাম ধান কিনে নেয়। তারা সরকারের তালিকাভুক্ত না হওয়ায় দিন দিন বেপরোয়া হচ্ছে। তাছাড়া অন্যান্য বছর কৃষি অফিস আমাদের সহযোগিতা নেয় কৃষকের তালিকা সংগ্রহের জন্য। কিন্তু এবার তারা কেউ যোগাযোগ করেনি।’

বাহাড়া ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জবা রানী দাস বলেন, ‘আমার এলাকা বড়। সবার কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই ফেসবুকে কৃষকদের তালিকাভুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছি।’ 

শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আলাউদ্দিন বলেন, ‘তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে আঁতাত করে কেউ কৃষকদের বঞ্চিত করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পাচ্ছি বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে ফড়িয়ারা কম দামে ধান কিনে মজুদ করছে। যারা ধান-চালের ব্যবসা করবে তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনতে আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব। তবে গুদামে কোনো কৃষক ধান দিতে এসে হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।’

সিলেট জেলায় এবার ২৪ হাজার ২৫৮ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ধান ৯ হাজার ৫৬৬ টন, সেদ্ধ চাল ৯ হাজার ৮৭৩ ও আতপ চাল কেনা হবে ৪ হাজার ৮১৯ টন।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সূত্র জানায়, অ্যাপের মাধ্যমে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলায় ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে। অ্যাপের আওতার বাইরের উপজেলাগুলো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করছে। তবে জেলার অনেক কৃষক অভিযোগ করেছেন, তারা সরকার নির্ধারিত দামে ধান-চাল বিক্রি করতে পারছেন না।

সিলেট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া মোস্তফা বলেন, ‘স্বচ্ছভাবে ধান সংগ্রহ চলছে। কোথাও কোনো অনিয়ম এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি।’

হবিগঞ্জের অনেক কৃষক অভিযোগ করেছেন, জেলায় সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ পুরোদমে শুরু হয়নি। এজন্য অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে তুলনামূলক কম দামে ফসল বিক্রি করে দিচ্ছেন। 

বানিয়াচংয়ের কৃষক রফিক মিয়া বলেন, ‘চাষাবাদ করতে গিয়ে অনেকে ঋণ করেন। ঋণ মেটাতে অনেকেই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন।’ ‘সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ১ হাজার ২৮০ টাকা মণ। আর আমরা পাইকারের কাছে বিক্রি করছি ৭৭০ টাকা মণ। এখন সরকার ধান কিনলেও আমাদের কোনো লাভ নেই।’

সফিক মিয়া নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমাদের কৃষি কার্ড থাকলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। আমরা তো বিক্রিই করতে পারছি না।’ 

জেলা খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী হবিগঞ্জ জেলার নয়টি উপজেলা থেকে ১৪ হাজার ৭৬০ টন ধান, ৪ হাজার ১৬৬ টন আতপ এবং ১৪ হাজার ৯৬৬ টন সেদ্ধ চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

জেলা খাদ্য কর্মকর্তা চাই থোয়াই প্রু মার্মা বলেন, ‘ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাইনি।’ 

বগুড়া জেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৬৫২ টন। এছাড়া ৫৫ হাজার ৪৩৭ টন  সেদ্ধ চাল, ২ হাজার ৬১৩ টন আতপ চাল ও ২১৬ টন গম সংগ্রহ করা হবে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় কৃষক সেজে ধান সংগ্রহ অভিযানে নেমেছেন অনেক মধ্যস্বত্বভোগী। তারা কৃষকের ধান বিক্রি করে দেয়ার নামে কৃষি কার্ড নিয়ে নিজেরাই সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করছেন। 

বগুড়ার কাহালু উপজেলার কৃষক আব্দুল বাছেদ জানান, ধান কাটা শুরু হতেই কয়েকজন এসে বলল, ধান জমি থেকে ওজন করে নিয়ে যাওয়া হবে। শুধু কৃষি কার্ড দিলেই হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বগুড়া সদর উপজেলার শাখারিয়ার এক কৃষক বলেন, ‘সরকারি গুদামে ধান দিলে পরে টাকা পাওয়া যায়। আর ব্যবসায়ীদের ধান দিলে নগদ টাকা পাওয়া যায়। এ টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা যায় দ্রুত।’

বগুড়া জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক হুমায়ন কবির বলেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’ 

নীলফামারী সদর উপজেলার চরাইখোলা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুর রহিম বসুনিয়া বলেন, ‘অনেক আশা করে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করার জন্য দুই বছর আগে নিবন্ধন করেছিলাম। তখন জানানো হয়েছিল পরে যোগাযোগ করা হবে, কিন্তু পরে আর কেউ যোগাযোগ করেনি।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রংপুর প্রতিনিধি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন