চিকিৎসা ব্যয় কমাতে যন্ত্রপাতির উপর করারোপ কমাতে হবে

প্রীতি চক্রবর্ত্তী, সিআইপি
চেয়ারম্যান, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
পরিচালক, এফবিসিসিআই

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে আসন্ন বাজেটে কি ধরণের নীতি প্রত্যাশা করেন?

বাংলাদেশে সরকারী ও বেসরকারী খাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের মানুষকে স্বাস্থ্য চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের উন্নতি অনেক, তবে এখনো অনেক মানুষ প্রতি বছর দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যায়। এতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আমাদের দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। আমার প্রত্যাশা আসন্ন বাজেটে এই বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। এছাড়াও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের উপর বিভিন্ন কর আরোপিত আছে যার ফলে জীবনরক্ষাকারী এসব যন্ত্রের খরচও যেমন বাড়ে তেমনই মানুষের কাছ থেকে সেবার বিনিময়ে অর্থও বেশী নেয়া লাগে, আমি আশা করবো আমাদের সরকার এই করের বোঝা এবার অবশ্যই কমাবেন।

দেশে সব মানুষের হাতের নাগালে চিকিৎসাসেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

আমাদের দেশে প্রায় ৭০% মানুষকে নিজস্ব অর্থায়নে চিকিৎসা সেবা নিতে হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আউট অব পকেট এক্সপেন্ডাচারের প্রায় আড়াই গুণ। একদিনে তো আর এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না, তবে আমাদের দেশে যদি স্বাস্থ্যবীমার প্রচলন ঘটে তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হবে বলে আমার বিশ্বাস। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট কম বা বেশি যা-ই দেয়া হোক না কেন, এ বাজেটের বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। এ অর্থের ব্যবহার ভালোভাবে হলে বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার মধ্যেই তিন-চার গুণ সেবা দেয়া যাবে। আরেকটি বিষয় হলো পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি)। সরকারের অনেক জায়গা আছে, যা আমরা ব্যবহার করতে পারি। একই সঙ্গে সরকার যদি তার বাজেটে বেসরকারী স্বাস্থ্যখাতকে অন্তর্ভুক্ত করে তাহলে ডায়ালাইসিস, বাইপাস সার্জারি, এনজিওপ্লাস্টি ইত্যাদির খরচ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে অবশ্যই পিপিপি’র বিষয়ে সরকারের উচিত অভিজ্ঞ ও সহযোগী মানসিকতার ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়া, এখানেও যদি সরকারী অংশীদারেরা বেসরকারী অংশীদারদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করে তবে ফলাফল সেই শূণ্যই হবে। আমার ব্যক্তিগত এক পিপিপি প্রজেক্ট এরকম জটিলতায় পড়ে আটকে গেছে, আমি নিজেও এর ভুক্তভোগী।

স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি ও খরচ কমানোর বিষয়ে আপনার মতামত কী?

স্বাস্থ্যসেবার ওপরে মানুষের আস্থা ধীরে ধীরে ফিরে আসলেও এখনো অনেকেই আমাদের মান নিয়ে প্রশ্ন করে। এর মূল কারণ যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো। এদের বেশীরভাগই কোন দক্ষ জনশক্তি ছাড়াই পরিচালিত হয়, ফলশ্রুতিতে মানুষ সেখানে গিয়ে প্রতারিত হবার পর সামগ্রিকভাবে পুরো স্বাস্থ্যখাতের নাম খারাপ হয়। সরকারের উচিত বিপিএমসিএ’র সাথে জয়েন্ট কলাবরেশনে একটি টাস্কফোর্স তৈরী করা, যারা এগুলোর মান যাচাই ও এরা কোন ধরণের ব্যতয় ঘটালে সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। সেইসাথে স্বাস্থ্যখাতের উপর আরোপিত কর সমূহ হ্রাস করলে ও সরকারের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া গেলে খরচও অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেসরকারি রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ও হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে, তবে মান বাড়ছে না। চিকিৎসায় অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ উঠছে নানা সময়ে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলায় আনতে কী পদক্ষেপ প্রয়োজন?

বিপিএমসিএ’র সাথে জয়েন্ট কলাবরেশনে একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা তো আমি বললামই। এর পাশাপাশি আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় লাইসেন্স যেমন জেনারেটর লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স, পরমাণু শক্তি কমিশন, পরীক্ষাগার, মন্ত্রণালয় এসব কাজ ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃপক্ষ থেকে নিয়ে একটা ওয়ান স্টপ সেন্টারে পরিণত করা উচিত। তাহলে আমাদের কাজের গতি যেমন বাড়বে তেমনই অযাচিত প্রতিষ্ঠানদের নিয়ন্ত্রণেও আনা যাবে। সেইসাথে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আলাদা শাখা থাকা উচিত। দেশের মানুষকে বেসরকারি খাত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেবা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকবল বাড়ানো উচিত। যাতে নিবন্ধন দেয়া, কোনো ঘটনা ঘটলে তার সুষ্ঠু তদন্ত করে তাত্ক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেয়া। এসব ক্ষেত্রে আমরা দুই পক্ষ না হয়ে এক পক্ষ হয়ে কাজ করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হবে। সারা বিশ্বে যেমন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এভাবেই একসঙ্গে কাজ করে।

যেকোনো ধরনের রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় তা পর্যাপ্ত কিনা?

একদমই পর্যাপ্ত নয়। সরকারের উচিত এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্র্যান্ড মার্কেটারদের নিয়োগ দেয়া যাতে তাদের তথ্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌছায়। এছাড়াও সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেনতা বৃদ্ধি করতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে আরো সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতকে সম্পৃক্ত করে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে।

দেশের চিকিৎসকদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় আধুনিকায়নে কী করা যেতে পারে?

সরকার ইতোমধ্যেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার বেশ ভালো একটি পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন। এ ব্যবস্থাপনাকে আরো কার্যকরী করার পরিকল্পনা করতে হবে। চিকিৎসা ডিগ্রি অর্জন করার পর কিন্তু আমরা জানি না, সরকারি চাকরিতে যাব নাকি বেসরকারি চাকরিতে যাব, নাকি প্রশাসনে। এটা যদি এমবিবিএস ফাইনালের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়, তাহলে অনেক বিষয় নিয়েই জটিলতা কমে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চিকিৎসক নিবন্ধন পেলে দুই বছর পর পর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নবায়ন করায়। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থা করা উচিত। এসব ছোট বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে আমরা বহু বছর এগিয়ে যাব। আজকে শুরু করলে হয়তো কয়েক বছর পর উপকার পাব। 

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে যেসব খাতে কম ব্যয় করা হয় তার মধ্যে স্বাস্থ্য খাত একটি। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

এ বিষয়ে আমরা অনেকদিন যাবতই অনেক কথা বলে যাচ্ছি, এবং আমরা আশা করি এই খাতে ব্যয় সরকার বাড়াবে। তবে তা তো আর একদিনে হবে না, বাস্তবতা হচ্ছে এটা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে যে ব্যয় সরকারের রয়েছে তাও যথাযথভাবে হলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।

বর্তমানে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি বেশ আলোচনায় রয়েছে। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন?

মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বর্তমানে অনেকটাই হাসপাতালগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কারণ আমরা নিয়ম নীতি মেনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করলেও যারা এই বর্জ্য আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে ডিসপোজ করার দায়িত্বে আছে তারা যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন বলেই অনেক অনিয়ম ঘটে। সরকার যদি এদের যথাযথ প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করেন তবে কয়েক বছরের মধ্যেই বলা যাবে বাংলাদেশ মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করে কাজ করতে হবে।

দেশের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা সমান নয়। এখানে সংকট কোথায়?

আমি আগেও বলেছি এটা আমাদের সিস্টেম্যাটিক সমস্যা। সরকার মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দেয়ার লক্ষ্যে অনেক বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি প্রদান করলেও কিছু অসাধু ব্যক্তি এর দুর্ব্যবহার করছেন। এসব মানুষকে শুদ্ধাচারের মধ্যে আনা, তাদের আরো জনবান্ধব করা, জবাবদিহিতা আরো বাড়ানো, এসবও কিন্তু সরকারের কাজ। সুনাম, অঙ্গীকার ইত্যাদি সব প্রতিষ্ঠানের সমান নয়। স্বাস্থ্য খাতে যাদের বড় বিনিয়োগ রয়েছে তাদের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট আরো তৈরি হলে বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া কঠিন কেননা এসব বিনিয়োগের বেশির ভাগই ব্যাংকঋণে করা।

এবারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যত কম হবে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ততই বাড়বে। আমি বুঝতে পারছি বৈদেশিক মুদ্রা, রিজার্ভ, বড় বড় প্রকল্পের মতো কার্যক্রমে সরকার এখন অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতও এদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এটাও সরকারের বুঝতে হবে।

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলার জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ও রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় উপাদান আমদানির ক্ষেত্রে বাজেটে কী নীতি থাকা উচিত?

উঃ সরকারের উচিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করে কাজ করা তাহলে নতুন ভালো উদ্যোক্তা পাওয়া যাবে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় বড় বিনিয়োগকারী তেমন একটা আসছে না কারণ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ অনেক নিরাপদ থাকে, সরকারের প্রণোদনাও পাওয়া যায়। চিকিৎসায় বিনিয়োগ সবাই ঝুকিপূর্ণ ভাবার আরেকটি বড় কারণ হলো করের বোঝা। অন্যান্য শিল্পের মতো এতেও কর বা শুল্ক থাকবে তা স্বাভাবিক কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে ১০০ শতাংশের বেশি কর দিতে হয় যা গ্রহনযোগ্য না। এসব ক্ষেত্রে যদি কর কমিয়ে আনা যায় তাহলে বিনিয়োগকারীরা আরো আসবে।

দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। গত কয়েক দশকের বাজেটে কী কী নীতি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে এগিয়ে নিয়েছে?

অবশ্যই সরকার বিভিন্ন নীতির মাধ্যমে বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা কে এগিয়ে নিয়েছে। সরকারের নীতি সহায়তার কারণে দেশের বেসরকারী খাতে এতগুলি মেডিকেল কলেজ হয়েছে। এদেশের চিকিৎসা শিক্ষা খাতে আমরা ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও উপরে ফরেন কারেন্সি নিয়ে এসেছি। বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত এতদূর এগিয়ে এসেছে। এখন প্রয়োজন বাজেটে বেসরকারী স্বাস্থ্যখাতের জন্য সুষ্পষ্ট নির্দেশনা থাকা। যাতে আমাদের ক্যাপাসিটি বিল্ড আপ হয় এবং আমরা স্কিল্‌ড নার্স ও কেয়ার গিভার রপ্তানী করে আরো ফরেন কারেন্সি দেশে আনতে পারি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন