মধ্যম আয়ের স্বপ্ন: অসহায় মানুষের ঝুঁকি

মনোয়ার মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক, গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে খাদ্যসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস হয়ে গেছে, আবার সরকার বলছে দারিদ্র্যের হার কমেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার একটা তাড়নাও আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম কেমন হওয়া উচিত?

বাংলাদেশ এখন দুটো ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এক. আমাদের অর্থনৈতিক লাইফলাইন অর্থাৎ গার্মেন্ট, রেমিট্যান্স, কৃষিআমরা এর বাইরে অন্য কোনো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটাতে পারিনি। কভিড ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিন ক্ষেত্রই সংকটের মধ্যে আছে।

দুই. বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে গ্র্যাজুয়েশনের পর্যায়ে থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থা বা দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে উন্নয়নসহায়তা পেত, তার পরিমাণ কমেছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির নানা সূচকে এগিয়ে গেলেও ব্যষ্টিক অর্থনীতির জায়গায় মানুষকে নানা সংকটে পড়তে হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানে ধস নেমেছে। সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত বলতে বাধ্য হচ্ছেন, বাজারে গেলে মানুষের কান্না আসে। সংকট দূর করার দুটো উপায় আছে।

এক. প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে, যার ফলে মানুষ নিজের সংকট নিজেই সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারবে।

দুই. যারা পারছে না তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা করতে হবে। এটাকেই আমরা বলছি সামাজিক সুরক্ষা।

বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের সমস্যা কী? কী করা উচিত?

কোনো আইনি কাঠামো না থাকলেও বিভিন্ন খাত উদ্দেশ্যভিত্তিক ১১৫টার মতো সরকারি সামাজিক সহায়তা প্রকল্প চালু আছে। ভিজিডি বা ভিজিএফের মতো বড় কর্মসূচির বাইরে অসংখ্য ছোট ছোট কর্মসূচি আছে। ছোট কর্মসূচিগুলোকে সমন্বিত করে ৩০-৪০টি বৃহৎ কর্মসূচিতে যাওয়া সম্ভব হলে অপব্যয় কমানো সম্ভব হবে।

জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্রে সরকার বলেছে, সরকার জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থান করবে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনে যত ধরনের ঝুঁকি, সেগুলো দূর করার জন্য রাষ্ট্র সহায়তা করবে। কৌশলপত্রের অ্যাপ্রোচ সামনে রেখে প্রচলিত যে অসংখ্য প্রকল্পভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে তাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তার পরিমাণ ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় মাসে ৫০০ টাকা বিধবা ভাতা বা মাসে ৮০০ টাকা প্রসূতি ভাতা একেবারেই অপর্যাপ্ত। রাতারাতি সরকারের পক্ষে হয়তো সব ভাতা বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়, কিন্তু পর্যায়ক্রমে ভাতার পরিমাণ আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা না করলে সমূহ বিপদ আছে। সিপিডির সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, নগরে থাকা চার সদস্যের পরিবারের মাসিক খরচ কমপক্ষে ২৪-২৫ হাজার টাকা, এমনকি সপ্তাহে একদিন আমিষ খেলেও। গ্রামীণ পরিবারগুলোর খরচ নিয়েও ধরনের গবেষণা আছে। কোনো জরিপ বা গবেষণাতেই সরকারের ৫০০, ৮০০ বা হাজার ১০০ টাকা ভাতাকে পর্যাপ্ত বলার সুযোগ নেই। ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সরকার যে ভাতা দিচ্ছে পরিমাণ নাগরিকের অধিকার কিংবা মানবিক মর্যাদা অথবা জীবনধারণের প্রয়োজন মেটানো, কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আবার দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা অন্য কোনো কারণে অসহায়, ঝুঁকিপূর্ণ অনেক মানুষ রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে অথবা যাদের সহায়তা পাওয়ার কথা নয়, তারা ভাতা পাচ্ছে। এটা দূর করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটা ডাটাবেজ তৈরি করা দরকার, যে ডাটাবেজ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে স্থানীয় সরকার।

তাহলে এখন সরকারের কৌশল কী হবে? বিশেষ করে কভিড-পরবর্তী আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পরিস্থিতির সময়ে...

কভিড অতিমারী দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষ কতটা অসহায়। বিশেষ করে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ চিত্র নির্মমভাবে ফুটে উঠেছে। কাজেই ধরনের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বা অন্যান্য ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমার মতো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা দরকার।

আমরা ২০২৬ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। বিপুল পরিমাণ মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে মধ্যম আয়ের ঝাণ্ডা উড়িয়ে কতটা সুখী হতে পারব আমরা? পরিকল্পিত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নই থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। জাতীয় বাজেটে সরকারের নীতিনির্ধারণী দলিলে সদিচ্ছার প্রতিফলন করতে হবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন