করপোরেট করহার কমানোর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না

এনবিআর সবসময়ই ব্যবসাবান্ধব নীতি তৈরির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে আসছে বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের প্রকৃত অগ্রগতি অর্জনের জন্য জনগণকে শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে বর্তমান সরকার অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতি লক্ষ রাখা হচ্ছে। এভাবে প্রতিটি নাগরিকের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের এসব প্রচেষ্টার প্রকৃত অর্থনৈতিক জোগানদাতা হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তার গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) অধিকাংশ সদস্যই এমসিসিআইয়ের সদস্য। আমার ধারণা মতে, সামগ্রিক জাতীয় রাজস্বের প্রায় ৪০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি আসে এমসিসিআইয়ের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। এভাবে এমসিসিআই ও এর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় রাজস্ব সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমসিসিআই বরাবরই রাজস্ব সংগ্রহ এবং নীতি বাস্তবায়নে এনবিআরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছে। স্বয়ংক্রিয় কর ব্যবস্থা বাস্তবায়নেও এমসিসিআই এনবিআরের পদক্ষেপের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর দিকে এগিয়ে চলছে। সব ক্ষেত্রেই আমরা উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করছি। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্ব এবং বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যানের সামগ্রিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে এনবিআর দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে।

আমাদের বাজেট প্রস্তাবের মধ্যে সবসময়ই বাজেট ব্যবস্থাপনা অধিকতর গতিশীল করার দিকে জোর থাকে। আমরা বিশ্বাস করি, বাজেট ব্যবস্থাপনা গতিশীল ও স্বচ্ছ হলে সব করদাতা স্বপ্রণোদিত হয়ে রাজস্ব প্রদান করবে। ফলে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। আমরা আমাদের বাজেট প্রস্তাবে সামগ্রিক কল্যাণ তথা দেশের কল্যাণ ও বিনিয়োগবান্ধব ব্যবসার বিষয়টি চিন্তা করে থাকি। যাতে একদিকে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য করা সহজ হয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে, অন্যদিকে দেশের রাজস্ব আয়েও কোনোরূপ নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। আমরা জনগণের বিদ্যমান আয় রক্ষা করে এমন প্রবৃদ্ধিভিত্তিক নীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে বাজেট প্রস্তাব দিয়ে থাকি।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। তখন সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে রফতানি খাত। বহির্বিশ্বের রফতানি পণ্যের কোটা বাতিল হবে। রফতানি বাজারে বাংলাদেশী পণ্যগুলোর ওপর নিয়মিত শুল্কহার প্রযোজ্য হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত ডব্লিউটিওর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ শুল্কহারের কারণে বছরে রফতানি খাতে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এমতাবস্থায় দেশীয় শিল্পের বিকাশ এবং সেবা খাতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক।

বিগত অর্থবছরে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মহামারী-পরবর্তী অবস্থা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবস্থা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে রাজস্ব আয় চাপের মধ্যে ছিল। তথাপি রাজস্ব আহরণের গতিকে স্বাভাবিক রাখতে এনবিআর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে মহামারী-পরবর্তী অবস্থা, যুদ্ধাবস্থা এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ের প্রতি এমসিসিআই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে:

১. কোম্পানিগুলোর করহার এবং কার্যকরী করহার (ইটিআর): বিগত অর্থবছরে কিছু শর্তসাপেক্ষে প্রায় সব ক্ষেত্রে করপোরেট করহার ২ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় হ্রাসকৃত কোম্পানি করহার সুবিধা কেউই ভোগ করতে পারছে না। অর্থ আইন, ২০২২ অনুযায়ী নগদ লেনদেনের শর্তাবলির প্রযোজ্যতার কারণে হ্রাসকৃত করহার সুবিধা নেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি ৮০ শতাংশের অধিক অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি। এ অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির মাধ্যমেই বাংলাদেশের শিল্প ব্যবস্থা ক্রমেই অগ্রসরমান। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় করহারের ক্ষেত্রে অর্থ আইন, ২০২২-এর শর্তাবলি বাতিল বিবেচনায় বিষয়টিতে সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অন্যপক্ষে আমাদের দেশে কার্যকর করপোরেট করহার অনেক বেশি। এখানে অননুমোদিত ব্যয় এবং উৎসে কর কর্তন এত বেশি যে আমরা ব্যবসায়ীরা এ করপোরেট করহার কমানোর সুবিধা ভোগ করতে পারছি না। বাস্তবে এ করপোরেট করহার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ আর থাকে না, তা ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে যায়। সুতরাং বিষয়টিও ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

২. সামগ্রিক কর ব্যবস্থাপনার ডিজিটালাইজেশন বা অনলাইনভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সহজীকরণ: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরের দিকে অগ্রসরমান। সরকার সব ক্ষেত্রেই অটোমেশনের দিকে জোর দিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাজেট ২০২২-২৩ পরবর্তী সময়ে বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ‘অনলাইনভিত্তিক আয়কর রিটার্ন যাচাইকরণ’ ব্যবস্থা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমাদান নথি নম্বর এবং তারিখ অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এ ব্যবস্থা আরো ফলপ্রসূ হবে।

এছাড়া ‘অনলাইনভিত্তিক ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্ন জমাদান’ পদ্ধতি আরো একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। 

তবে করদাতারা সব ধরনের দলিল অনলাইনের মাধ্যমে সংযুক্তির সুবিধা পেলে এ অনলাইনভিত্তিক আয়কর রিটার্ন জমাদান পদ্ধতি অনেক জনপ্রিয়তা পাবে বলে এমসিসিআই বিশ্বাস করে।

ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যারের মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় সব কোম্পানি মাসিক ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে থাকে। তবে এ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে অটোমেশন নয়। ই-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অটোমেশন ব্যবস্থা গতিশীল হবে বলে এমসিসিআই মনে করে। এছাড়া ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব উপাদানকেই পণ্য বা সেবার উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করে আইনের ধারা পরিবর্তন সাপেক্ষে রেয়াত ব্যবস্থার অটোমেশন পূর্ণাঙ্গরূপে গতিশীল হবে বলে এমসিসিআই বিশ্বাস করে।

সময়ের চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে কর নির্ধারণ ব্যবস্থা, আপিল, ট্রাইব্যুনাল, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পর্যায়ে প্রচলিত আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়নপূর্বক অনলাইনে শুনানি গ্রহণের বিধান প্রবর্তন করা অতীব জরুরি। এছাড়া করদাতাদের নোটিস প্রদান, শুনানিতে করদাতাদের হাজিরা পদ্ধতি ইত্যাদি আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে অনলাইনভিত্তিক হওয়া খুবই জরুরি। এ ব্যবস্থার ফলে ব্যবসায়ীদের অর্থ ও সময়ের অপচয়সহ ব্যবসায়িক ব্যয় হ্রাস পাবে।

৩. আয়কর রিটার্ন জমাদানের প্রমাণপত্র (পিএসআর): বর্তমানে ১৮৪এ ধারা অনুযায়ী ৩৮টি ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমাদানের প্রমাণপত্র দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ব্যাপকসংখ্যক পিএসআর দাখিলের বিধান ব্যবসার সক্ষমতা হ্রাসের পাশাপাশি ব্যবসা সহজীকরণের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে ব্যাহত করছে। পিএসআর সংগ্রহকারীর পক্ষে হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা জটিল হচ্ছে। কোম্পানিগুলো এনবিআরের পক্ষে আইনসিদ্ধভাবে কর ব্যবস্থাপনা তদারক করে। পক্ষান্তরে, আয়কর আইনবহির্ভূতভাবে অনেক সময় পিএসআরে তথ্যাবলি ছাড়াও করদাতাদের আয়ের বিবরণ, কর প্রদানের পরিমাণসংক্রান্ত সংবেদনশীল তথ্যাবলি সংগ্রহ করা যৌক্তিকও নয়। তাছাড়া রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা থাকা সত্ত্বেও হালনাগাদকৃত পিএসআর দাখিলের বিধান সাংঘর্ষিক ও বাস্তবসম্মত নয় বলে পরিলক্ষিত হয়। ফলে এ বিধানের ক্ষেত্রগুলো বাস্তবসম্মতভাবে বিবেচনাপূর্বক পরিসর সীমিত করার বিষয়ে চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

৪. আমদানি পর্যায়ে কাস্টমস কর্তৃক মূল্য নির্ধারণ: বর্তমান বাস্তবতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পণ্যের বিনিময়মূল্যকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে ডাটাবেজ মূল্য বা রেকর্ড মূল্যকে শুল্কায়নের মূল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমতাবস্থায় আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং আন্তর্জাতিক বাজারের হালনাগাদ তথ্যের ডাটাবেজ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে সাবস্ক্রাইবের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ অটোমেশন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করতে চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

৫. স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ও বিস্তৃতির জন্য সহায়ক পদক্ষেপ: বর্তমানে দেশের ৪০ লাখ কর্মী রয়েছে, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬০ বছর। তারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত নয় (এনইইটি)। এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারে নিয়ে আসা খুবই জরুরি। তাদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা গেলে আমাদের জিডিপির ওপর অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় শিল্পের বিকাশ খুবই জরুরি। স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তারা স্থানীয় পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে, অন্যদিকে কর্মস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আয়কর হার, মূসক ব্যবস্থাপনা, শিল্প যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানির শুল্কহার, সম্পূরক শুল্কহার যথাযথভাবে বিবেচনা করে স্থানীয় শিল্প সম্প্রসারণে সরকার সদয় দৃষ্টি দেবে বলে এমসিসিআই বিশ্বাস করে।

৬. মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করহার পুনর্বিন্যাস: ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে সম্পূর্ণভাবে বের হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এ বাস্তবতায় আয়কর হার, ভ্যাট হার, সম্পূরক কর, শুল্কহারসহ কাস্টমস ডিউটি পুনর্বিন্যাস করা আবশ্যক। তাছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশের নিরিখে সম্পূর্ণ অটোমেশন ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিকল্পনা খুবই জরুরি। এমতাবস্থায় বর্তমান বাজেট প্রস্তাব থেকে এর রূপরেখা বা পরিকল্পনা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন