ইলেকট্রনিকস খাতে দীর্ঘমেয়াদে কর অব্যাহতি প্রয়োজন

মো. নুরুল আফছার , উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইলেক্ট্রো মার্ট গ্রুপ

বছর অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য খানিকটা কঠিন। ডলার সংকটসহ চলমান জটিলতায় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদকদের কোনো সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় কি?

আমরা দেশে যেহেতু উৎপাদন করি, কাঁচামালগুলো দেশে পাওয়া যায় না। ফলে বিদেশ থেকে আনতে হয়। বিগত তিন বছর করোনার কারণে দাম অনেক বেশি ছিল। এখন আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, তার মধ্যে ডলার সংকট। এসব কারণে আমদানি করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে যেভাবে সহজে এলসি করতে পারতাম এখন সেভাবে করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে সরকার আমাদের সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমরাও চেষ্টা করছি আরো ভালোভাবে কীভাবে ব্যবসা করা যায়। একটু তো ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে। তাছাড়া জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি তো আছেই।

এবারের বাজেটে আপনার কী রকম সুযোগ-সুবিধা চান?

সরকার আমাদের ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারীদের জন্য ২০২৩ সাল পর্যন্ত একটা ছাড় দিয়েছে। এটি হচ্ছে কর অব্যাহতি। আমরা চাই এটি যেন দীর্ঘমেয়াদি করে। ২০৪১ সাল পর্যন্ত যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি ভিশন আছে। আমরা (বাংলাদেশ) যেহেতু মাত্র ইলেকট্রনিকস ইন্ডাস্ট্রি শুরু করেছি, ফলে আমি চাই যে সরকার অন্তত ১০ বছর সহযোগিতা করুক। সরকার যদি সহযোগিতা করে তাহলে আমরাও তৈরি পোশাক খাতের মতো রফতানি করতে পারব। সেই সহযোগিতা সরকারের কাছে চাই। সরকার যদি খাতে কর অব্যাহতির সময়টা বৃদ্ধি করে দীর্ঘমেয়াদে তাহলে আমরা মনে করি যে আরো নতুন নতুন বিনিয়োগ আসবে বিদেশীদের কাছ থেকে। পাশাপাশি আমাদের দেশে এখন যে ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে সবগুলোই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এছাড়া কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে যেন কর অব্যাহতি দেয়া হয়। তাহলে আমরা কম মূল্যে ভোক্তাদের পণ্য দিতে পারব। এতে বিদেশী পণ্যের ওপর মানুষের নির্ভরযোগ্যতা কমবে।

গুণগত মানের জায়গায় বিদেশী পণ্যের সঙ্গে দেশীয় পণ্য কতটুকু প্রতিযোগিতায় সক্ষম?

বিশ্বের প্রায় ২০০টা দেশে কনকা এবং গ্রী সমাদৃত ব্রান্ড। দুটি কোম্পানির সঙ্গে আমরা বাংলাদেশে যৌথভাবে উৎপাদন করছি। ফলে আমাদের পণ্যও গুণগত মানের দিক থেকে কোনো অংশেই কম না। আমরা এখানে যেসব পণ্য উৎপাদন করি সেগুলো আমাদের এখানকার বাজার বিবেচনায় নিয়ে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী নতুনভাবে ডিজাইন করে উৎপাদন করে থাকি। আমাদের এখানে যারা কাজ করছেন, তারাও নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। চীন বা অন্য দেশগুলোতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, কারণ সেই সব দেশে শ্রমিকের দাম অনেক বেশি। আমাদের দেশে সুযোগ আছে যে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক পণ্য রফতানি করতে পারব। যদি সরকার আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দেয় তাহলে সেটি সম্ভব।

যারা দেশীয় উৎপাদক, তাদের জন্য ডলার সংকটের সময়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি? যাতে রফতানির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য চাহিদামতো কাঁচামাল আদানির সুযোগ দেয়া হবে?

আসলে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই চাচ্ছে যে এলসি বা আমদানি ঠিক রাখার জন্য। যাতে উৎপাদন স্বাভাবিক থাকে, কারখানাগুলো সচল থাকে। আমরা চাই যে আরো সহজে কীভাবে এলসি করা যায়, ওয়ান স্টপ সলুশনের মাধ্যমে দ্রুত পাই। তাহলে আমাদের কাঁচামাল পেতে সুবিধা হয়, উৎপাদনটা ব্যাহত হবে না। এটি না হওয়ায় আমাদের দুই মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে হয়। নানা পদক্ষেপ নিতে হয়, তখন খরচ বেড়ে যায়। আমাদের যখন প্রয়োজন তখন আমরা কাঁচামাল আমদানি করব, তাহলে আমাদের কাজটা সহজ হয়, উৎপাদন ঠিক থাকে।

ব্যাংকঋণ পাওয়া নিয়ে কিছু জটিলতার অভিযোগ আছে। আবার ঋণের সুদ নিয়ে আপনাদের কিছু দাবি ছিল। বিষয়টি এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে?

কয়েক বছর ধরে সরকার চেষ্টা করছে ঋণের সুদ শতাংশের মধ্যে রাখার। সে জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এখন ক্যাপ সিস্টেম তুলে দেয়ায় আমরা আশঙ্কা করছি যে ঋণের সুদহার বাড়বে, সিঙ্গেল ডিজিট ( শতাংশ বা তার কম) থাকবে না। আমরা আবেদন জানাব যেন সরকার সিঙ্গেল ডিজিট রাখে এবং সেটা আরো অন্তত সাত-আট বছর থাকে। এটি হলে আমাদের দেশটা উৎপাদনের একটি হাব হবে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে তখন আমরা রফতানি করতে পারব। বিভিন্ন রকম পণ্য, শুধু তৈরি পোশাক বা ইলেকট্রনিকস পণ্য নয়। অন্য সব পণ্যের জন্যও সুযোগ দেয়া উচিত। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা চায় যে দ্রুত মূলধনের জোগান। এটি দীর্ঘায়িত হলে তখন প্রজেক্টটাও দীর্ঘায়িত হয়ে যায়। তখন সুদের অংক বাড়ে, খরচ বাড়ে। যাদের কাগজপত্র সব ঠিক থাকে, ভালো ব্যবসায়ী তাদের ক্ষেত্রে যাতে দ্রুত সেবাটা দেয়া হয়, ঋণটা দেয়া হয় সেটি সরকারের উচিত নিশ্চিত করা।

স্থানীয় বাজারে দেশীয় উৎপাদকদের হিস্যা কেমন? আগের তুলনায় বেড়েছে নাকি কমেছে?

দেশের চাহিদা প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্যই দেশে উৎপাদন হয়। এবং গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। ফলে আমদানি অনেক কমেছে। সরকার যদি সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় তাহলে আমি মনে করি ৯০ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব। ১০ শতাংশ হয়তো আমদানি হবে তখন। ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা তাদের সেবা দিতে পারব ইনশা আল্লাহ।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য কোনো রকম নীতিসহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করেন কি?

বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসলে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চায়। আমাদের দেশে যে প্রতি বছর বাজেট হয় একটা বাজেটে যে সুবিধা দেয়া হয়, পরের বাজেটে দেখা যায় সেটি থাকে না। অথবা সুবিধাগুলো এক বছরের জন্য বা স্বল্প সময়ের জন্য দেয়া হয়। এখন সরকার যদি একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দেয় যে এটা আগামী ১০ বছর, বছর এভাবেই থাকবে পরিবর্তন হবে না। তাহলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা একটা নিশ্চয়তা পাবে। তখন বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে। যেহেতু বিনিয়োগ করলে পরের বছরই রিটার্ন আসে না। এর জন্য থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। সরকার এরই মধ্যে চেষ্টা করছে অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার এবং সফলও হচ্ছে।

অভিযোগ আছে কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে অনেক পণ্য দেশে আসে। বিষয়ে আসলে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন?

এটি আমাদের জন্য বিপজ্জনক। এত টাকা বিনেয়াগ করে কাজ করছি, এত লোক কাজ করছে। কর ফাঁকি দিয়ে আনার কারণে তার খরচ কম পড়ছে এবং সে দেশে কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে আমরা দেশে যারা আছি তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এটা বন্ধে সরকার যেন সচেতন হয়। যে যে বন্দর আছে সেখানে যারা কর্মকর্তা আছেন, তারা যেন সচেতন হন, যেন ধরনের পণ্য দেশে প্রবেশ করতে না পারে। অন্যথায় দেশীয় উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফাজ্জল হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন