চিনির কেজিতে ২৫ টাকা বেশি

সরকার নির্ধারিত দাম মানছে না ব্যবসায়ীরা

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে একের পর এক দাম নির্ধারণ করছে সরকার। তবে সরকার নির্ধারিত এসব মূল্য মেনে চলছেন না ব্যবসায়ীরা। গ্রীষ্মকালীন চাহিদা, রোজা ও ঈদে বাড়তি চাহিদার কারণে নিত্যপণ্যটির সরবরাহ সংকট রয়েছে বাজারে। ফলে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে চিনির পাইকারি ও খুচরা বাজারে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি অন্তত ২৫ টাকা। সর্বশেষ ঈদে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি চিনি বিক্রি হয়েছে ১৩০-১৩৫ টাকায়। 

পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের পর থেকে কয়েক দিন ধরে পাইকারি বাজারে লেনদেন প্রায় বন্ধ। এদিকে খুচরা বাজারে চিনির চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ তুলনামূলক কম থাকায় নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশিতে লেনদেন হয়েছে পণ্যটি। কোথাও কোথাও পণ্যটি কেজিপ্রতি ১৩৫ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দেশীয় মিলগুলোর চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বা উৎপাদন কম হওয়া ছাড়াও বাজার তদারকির অভাবে অস্বাভাবিক বাড়তি মূল্যে চিনি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

৬ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনির দাম পুনর্নির্ধারণ করে। নতুন দরে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হবে ১০৪ ও প্যাকেট চিনি ১০৯ টাকায়। এর আগে একই মানের চিনির দাম ছিল যথাক্রমে ১০৭ ও ১১২ টাকা। পাইকারি বাজারে মণপ্রতি ৪ হাজার টাকায় চিনি কিনে সেটি খুচরা পর্যায়ে কোনোভাবেই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি সম্ভব নয় বলে দাবি খুচরা ব্যবসায়ীদের। আরো আগে চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং রোজা ও গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ কমিয়ে দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতেও পাইকারি পর্যায়ে চিনির দাম কমেনি। সর্বশেষ সরকারিভাবে চিনির দাম কেজিপ্রতি আরো কমিয়ে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে নতুনভাবে দাম নির্ধারণের পরও স্থিতিশীলতায় ফেরেনি চিনির পাইকারি বাজার। গরমে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বরং দাম আরো বেড়েছে। এ কারণে ঈদের সপ্তাহে প্রতি কেজি চিনি সরকারি দামের তুলনায় ২৫-৩০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।

১৪ এপ্রিল পাইকারি বাজারে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনির দাম ছিল ৪ হাজার টাকা। এরপর কয়েক দিনের ব্যবধানে চিনির পাইকারি দাম বেড়ে মণপ্রতি ৪ হাজার ২০০ টাকায় ওঠে। এছাড়া ঈদের আগে পাইকারি দাম আরো এক দফা বেড়ে ৪ হাজার ৩০০ টাকা হয়। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে চিনির দাম নিম্নমুখী। বর্তমানে চিনিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে তেমন একটা প্রতিবন্ধকতাও নেই। তবে ডলার সংকট ছাড়াও ব্যাংকের নির্ধারিত দামের পরিবর্তে কার্ব মার্কেট থেকে বাড়তি দামে ডলার ক্রয়ের কারণে ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি আমদানি করতে পারেননি। এ কারণে প্রদর্শিত দামের চেয়েও বেশি দামে আমদানি করায় বাড়তি দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া ডলার সংকটের কারণে আমদানি সীমিত হওয়ার পাশাপাশি গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে দেশীয় চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকায় চিনির বাজার নিয়ে সংকট সহসা কাটছে না বলে মনে করছেন তারা। 

দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক মাস আগে দেশে চিনির পাইকারি দাম মণপ্রতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪০০ টাকায়। তবে শীত মৌসুমে চাহিদা কমে আসার পাশাপাশি আমদানি স্বাভাবিক হয়ে এলে দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। গ্রীষ্মকালীন মৌসুমের বাড়তি চাহিদা ছাড়াও রোজায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে এনবিআর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়। আগে চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ হলেও প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে কাস্টমসে শুল্কায়ন করা অপরিশোধিত চিনিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে আমদানিকারকদের। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জারি করা গেজেটে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি ৩ হাজার টাকা, পরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি ৬ হাজার টাকা স্পেসিফিক ডিউটি (ফিক্সড ডিউটি) প্রত্যাহার করা হয়। হ্রাসকৃত শুল্ক সুবিধা আগামী ৩০ মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানানো হয়। শুল্ক কমানোর পরও পাইকারি বাজারে দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। 

বাংলাদেশ পাইকারি চিনি ডিলার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চৌধুরীবণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঈদের কারণে বেসরকারি মিলগুলো থেকে সরবরাহ কমে গেছে। গরম ও ঈদের চাহিদা বেশি থাকায় ছুটির মধ্যেই চিনির দাম কেজিপ্রতি অন্তত ১০ টাকা বেড়ে গেছে। সরকারি মিলগুলোয় চিনি উৎপাদন শুরু হলেও ডিলার পর্যায়ে দেশব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল হওয়ায় দেশের বাজারে চিনির দাম নিয়ে অস্থিরতা চলছে।’ এছাড়া সরকারি পর্যায়ে আমদানির পাশাপাশি দেশীয় মিলের চিনি সরবরাহ না বাড়ালে চিনির দামে নতুন রেকর্ড হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

তথ্য বলছে, দেশে বার্ষিক চিনির চাহিদা প্রায় ২২-২৪ লাখ টন। প্রতি মাসে চাহিদা থাকে দেড়-দুই লাখ টন। তবে রোজা ও গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে চিনির চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে শরবতসহ মিষ্টিজাতীয় খাবারের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং রোজার মাসে শরবত ছাড়াও মিষ্টিজাতীয় সুস্বাদু খাবারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় চিনির চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে বাড়তি চাহিদা সামনে রেখে মিল গেট থেকে শুরু করে ভোক্তা বাজার পর্যন্ত চিনির দাম নিয়ে অস্থিরতা দেখা দেয়। চিনির বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিতে মৌসুমের আগে পাইকারি ও খুচরা বাজারে মজুদপ্রবণতা বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক চাহিদা বাড়ার কারণে অপরিশোধিত চিনির পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরিশোধিত চিনি আমদানি শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। 

একসময় দেশে চিনির বার্ষিক নিজস্ব উৎপাদন ছিল দেড়-দুই লাখ টন। সরকারি ১৫টি চিনিকলে এসব চিনি উৎপাদন হতো। তবে দুই বছর ধরে দেশের ছয়টি চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে সরকার। যার কারণে উৎপাদন কমে ২৫-৩০ হাজার টনে নেমে আসে। এ বছর চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার টন। ২৫ নভেম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে নয়টি চিনিকলে মাড়াই মৌসুম শুরু হয়। গত দুই মৌসুমের মতো পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, পাবনা ও কুষ্টিয়া চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সরকারি চিনি সরবরাহ কার্যত বন্ধ থাকায় বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো দেশের চিনির বাজারে দাম নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন