ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি

ব্যয়বহুল মনে হলেও সাশ্রয়ী

রেশমা জাহান

ছবি: গোল্ডকোস্টওমেনকেয়ারডটকম

আগে যেখানে সার্জারি মানেই ছিল অনেক বড় কাটা দাগ, কষ্ট আর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে ভর্তি থাকার যন্ত্রণা। এখন অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে সেই চিত্রে। আধুনিক পদ্ধতি ও উন্নত সব প্রযুক্তিতে এখন বড় বড় সার্জারিও হচ্ছে ছোট আকারে। আর এসব কারণেই জনপ্রিয় হচ্ছে ল্যাপারোেস্কাপিক সার্জারি।

খুব বেশিদিন হয়নি দেশে এ চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন চিকিৎসকরা। এরই মধ্যে এ চিকিৎসার সুফল পেয়েছেন অনেক রোগী। আরো অনেক চিকিৎসক আগ্রহী হচ্ছেন এ সার্জারি নিয়ে কাজ করতে এবং রোগীরা আগ্রহী হচ্ছেন এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিতে।

ল্যাপারো কথার অর্থ পেট। ল্যাপারোটমি বলতে সাধারণত পেটকে খোলা বা কাটাকে বোঝানো হয়। অন্যদিকে স্কোপ শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয় পেটের মধ্যে ক্যামেরা দিয়ে দেখা। মাইক্রোস্কোপে যেমন ছোট জিনিস দেখা যায়, টেলিস্কোপে দূরের জিনিস দেখা যায় ঠিক সেভাবেই ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির অর্থ হলো পেটের মধ্যে ক্যামেরা ঢুকিয়ে সার্জারি করা। এ পদ্ধতিতে সার্জারি করার সময় পেটে ছোট ছোট তিন-চারটি গর্ত করা হয়। তার একটি দিয়ে ক্যামেরা প্রবেশ করানো হয়। অন্যগুলো দিয়ে যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে যেমন পেটে কোনো রোগ আছে কিনা সেটা নির্ণয় করা যায়, পাশাপাশি প্রয়োজনে অপারেশনও করা যায়। 

পেট কেটে অপারেশনের বদলে এ পদ্ধতিতে সার্জারি করার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। এভারকেয়ার হাসপাতালের জেনারেল অ্যান্ড ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির সিনিয়র কনসালট্যান্ট অ্যান্ড কোঅর্ডিনেটর এস এম আবু জাফর বলেন, এ সার্জারির সুবিধা হলো রোগীর পেট বড় করে কাটার দরকার পড়ে না। ফলে ব্যথা কম হয়, রিকভারি দ্রুত হয়, পেটে বড় একটা দাগ থাকে না। যেহেতু দ্রুত সুস্থতা পেতে পারে তাই রোগীরা খুব দ্রুত কাজে ফিরে যেতে পারে। তার লম্বা সময় বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। 

তবে রয়েছে কিছু অসুবিধাও। এ সার্জনের মতে, এ সার্জারিতে উন্নত সব প্রযুক্তি এবং দামি দামি সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, সেজন্য খরচ বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া ল্যাপারোস্কোপি শিখতে একজন সার্জনের বেশি সময় লাগে। সেটা সার্জনের জন্য বা যিনি শিখতে চান তার জন্য সমস্যা হতে পারে। সুপারভাইজারের লম্বা সময় ট্রেনিং প্রয়োজন হতে পারে। আরেকটি অসুবিধা হলো হার্নিয়া অপারেশন করতে হলে আমরা সাধারণত নিচের অংশ অবশ করে করতে পারি কিন্তু ল্যাপারোস্কোপি হার্নিয়া অপারেশন করতে হলে পুরো অজ্ঞান করে জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে করতে হয়। সেটা অনেক রোগী করতে চান না। যদিও এখন জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া ও স্পাইনাল অ্যানেস্থেশিয়ার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই।  

তবে সেটা মোটেও ভয়ের কিছু নয়। পেট কেটে করা অপারেশনে যেসব জটিলতা দেখা দেয় ল্যাপারোস্কোপিতেও একই ধরনের জটিলতার আশঙ্কা রয়েছে। আবু জাফরের মতে, পুরো পেট কেটে যে অপারেশন করা হতো সেটাই এখন ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে হচ্ছে। সবকিছুর উদ্দেশ্য রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে কাজে ফেরত পাঠানো। ফলে ওই অপারেশনে যেসব জটিলতা হতে পারত, এখানেও তা হতে পারে। সুতরাং স্বল্পমেয়াদে বা দীর্ঘমেয়াদে কোনো জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা দুই ক্ষেত্রে একই রকম। কোনো বাড়তি জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা কম। শুধু একটা বিষয় হতে পারে, আমরা প্রথম যে ছিদ্রটা করি সেটা না দেখে করতে হয়। যদিও এখন অনেক যন্ত্রপাতি এসে গেছে যেটা দেখে দেখে পেটের ভেতর চলে যায়। ফলে বলা যায়, ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে অসুবিধার থেকে সুবিধা বেশি।

ল্যাপারোস্কোপির সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্জারি ল্যাপারোস্কোপিক্যাল সিস্টেকটমি। অর্থাৎ গল ব্লাডার বা পিত্তথলির সার্জারি। ল্যাপারোস্কোপি আসার আগে পিত্তথলির সার্জারি করতে হতো পেট কেটে। পিত্তথলিতে পাথর, টিউমার বা হয়তো পলিপ আছে। সেটা না দেখে তো আর অপারেশন করা যাবে না। আগে পেট কেটে দেখতে হতো। এখন সেটা দেখা যায় ক্যামেরা দিয়েই। ল্যাপারোস্কোপ বা এ ধরনের ক্যামেরা দিয়েই এখন শরীরের প্রায় সব অংশেই কাজ হয়। সাধারণ সার্জারিতে যেমন গল ব্লাডার, অ্যাপেনডিক্স, হার্নিয়ার অপারেশন করা যায়, তেমনি ল্যাপারোস্কোপিতেও এখন সব সার্জারি করা হয়। গাইনির প্রায় সব সার্জারি ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে হয়। যেমন: ওভারিয়ান সিস্ট, চকোলেট সিস্ট, সিম্পল সিস্ট, হিসট্রেকটমি সব ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে করা যায়। তেমনি ইউরোলজিস্টরা ইউরোলজিক্যাল সব সার্জারিও এখন ক্যামেরা টেকনোলজি দিয়ে করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সার্জারিও এ পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। 

এটি পুরোটাই একটা প্রযুক্তিনির্ভর সার্জারি। সাধারণ সার্জারির যন্ত্রপাতির থেকে এখানে কিছু বাড়তি যন্ত্রপাতি লাগে। ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে ব্যবহারের জন্য ক্যামেরা, আলোর উৎস (লাইট সোর্স), মনিটর এগুলো খুব দামি নিতে হয়। তাই একটু বাড়তি টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়। কিন্তু দিন শেষে বলা যায়, ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি অন্য সার্জারির তুলনায় সাশ্রয়ী। তার কারণ এতে হাসপাতালে থাকার সময় কমে যাচ্ছে। রোগীকে সাতদিন হাসপাতালে থাকতে হলে তার যে পরিমাণ টাকা খরচ হবে, সেই টাকা যদি সে ল্যাপারোস্কোপিতে খরচ করে তবে প্রায় সমানই দাঁড়াবে। তাছাড়া আমাদের দেশে দ্রুত কাজে ফিরে যাওয়া আর্থিকভাবে জরুরি। কেননা অনেকেই এমন কাজে জড়িত থাকেন যারা অফিসে না গেলে আয় করতে পারবেন না। সুতরাং সার্বিকভাবে চিন্তা করলে এ সার্জারি যন্ত্রপাতির কারণে ব্যয়বহুল মনে করলেও অন্যদিক থেকে উপকারিতা অনেক বেশি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন