নবজাতকের জন্ডিস

জেলা-উপজেলায়ও আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি রাখতে হবে

অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক। দীর্ঘদিন শিশুরোগের ওপর অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন। অবদান রেখেছেন চিকিৎসাসেবায়। নবজাতকের জন্ডিসের কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়ে এ শিশু শ্বাসতন্ত্রের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

জন্মকালীন জন্ডিস কত শতাংশ শিশুর হয়? এর কোনো কারণ আছে কি?

নবজাতকের জন্ডিস খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ৭০ শতাংশ শিশুরই এ জন্ডিস হয়। কারণ শিশুর জন্ম হয় অনেক হিমোগ্লোবিন নিয়ে। তখন হিমোগ্লোবিনের মাত্রা থাকে প্রায় ১৪-২০ পর্যন্ত। মাতৃগর্ভে শিশুরা অক্সিজেনের স্বল্পতায় ভোগে। মায়ের মাধ্যমে যে অক্সিজেনটা পায় সেটা পর্যাপ্ত নয়। তখন হিমোগ্লোবিনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। জন্মের পর সে বাতাসে অক্সিজেন পায়। তখন আর তার অত হিমোগ্লোবিনের দরকার হয় না। ফলে হিমোগ্লোবিন বা আরবিসি ভেঙে যায়। আরবিসি ভাঙার ফলে বিলিরুবিন বেড়ে যায়, দেখা দেয় জন্ডিস। সাধারণত জন্মের সময়ই এ সমস্যা শুরু হয় না। জন্মের দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন থেকে শুরু হয়। বাড়তে বাড়তে চার-পাঁচ দিনে বিলিরুবিন সর্বোচ্চ মাত্রায় যায়, পরে নয়দিনের মাথায় আবার কমে আসে। এটাকে বলা হয় সাধারণ ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস। এটা নিয়ে আমরা তেমন ঘাবড়াই না, ভয়ও পাই না। যদি এই জন্ডিস ১৪ দিন পরও থেকে যায় তাহলে বলা হয় পারসিস্ট্যান্ট নিউন্যাটাল জন্ডিস। তখন এর কারণ বের করতে হয়। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যদি জন্ডিস হয় এবং হিমোগ্লোবিন কমে যায়, তাহলে বলা হয় ব্লাড গ্রুপিং কম্প্যাটিবিলিটি। যদি মায়ের আরএইচ নেগেটিভ হয় এবং সন্তানের আরএইচ পজিটিভ হয় তাহলে হিমোগ্লোবিন ভেঙে যায় দ্রুত, সেটাকে বলে হিমোলাইটিক জন্ডিস। আবার মায়ের যদি ও গ্রুপের ব্লাড থাকে আর সন্তানের এ বা বি গ্রুপের হয়, তাহলেও তাদের মধ্যে ইনকম্প্যাটিবিলিটি হয়। তখন সন্তানের প্রথম দিনই জন্ডিস হতে পারে। এটাকে বলে এবিএম কম্প্যাটিবিলিটি। জন্মগত রেয়ার ডিজিজ থাকলেও জন্ডিস হয়। দুই ধরনের বিলিরুবিন আছে। ডাইরেক্ট বিলিরুবিন আর ইনডাইরেক্ট বিলিরুবিন। ডাইরেক্ট বিলিরুবিন হলে বুঝতে হবে সেটা প্যাথলজিক্যাল, সেটা কখনো ফিজিওলজিক্যাল না। ডাইরেক্ট বিলিরুবিন বাড়লে চিন্তা করতে হয় আমাদের লিভারের কোনো সমস্যা আছে কিনা এবং লিভারের চ্যানেলের কোনো সমস্যা আছে কিনা। তাছাড়া টর্চ ইনফেকশন হলেও এ সমস্যা দেখা দেয়। কিছু মেটাবলিজম ডিজিজেও এ সমস্যা দেখা দেয়। 

এসব জন্ডিস কি প্রতিরোধযোগ্য?

ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস সাধারণত প্রতিরোধ করা যায় না, প্রতিরোধ করার দরকারও হয় না। কিন্তু আরএইচ কম্প্যাটিবল জন্ডিস প্রতিরোধ করা যায়। ধরেন সন্তান যদি আরএইচ কম্প্যাটিবল হয় তখন যদি তাকে একটা ইনজেকশন দেয়া হয় তখন তার জন্ডিস হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। এটা প্রতিরোধযোগ্য। আবার এবিএম কম্প্যাটিবিলিটি প্রতিরোধ করা যায় না কিন্তু সতর্ক থাকতে হয়। মায়ের ও পজিটিভ রক্ত এবং সন্তানের ওবি পজিটিভ রক্ত হলে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ফটোথেরাপির মাধ্যমে আমরা তার জন্ডিস কমিয়ে দিই। এসব জন্ডিস কিছুদিন থাকে, তারপর ভালো হয়ে যায়। তবে বিরল রোগে যেসব জন্ডিস হয় সেগুলো ভালো করা কঠিন। সেসব প্রতিরোধও করা যায় না।

নবজাতকের জন্ডিসের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বে ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে কোনো তারতম্য আছে কি?

এটা সব দেশেই একরকম। কোথাও কম হবে কোথাও বেশি হবে, এমন না। 

প্রসূতির প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে জন্ডিস কি ভ্যারি করে? 

কোনো মায়ের রক্তের গ্রুপ যদি নেগেটিভ থাকে এবং সন্তানের গ্রুপ যদি পজিটিভ হয় তাহলে প্রথম সন্তানে কোনো প্রভাব দেখা যায় না, যদি এর আগে মায়ের কোনো গর্ভপাত না হয়ে থাকে। কিন্তু প্রথম সন্তান এমন হওয়ার পরও যদি মাকে আমরা প্রিভেন্টিভ এন্টেডি না দিই তাহলে দ্বিতীয় সন্তানের সিরিয়াস হিমোলাইটিক জন্ডিস হয়ে যায়। তখন শিশুকে রক্ত দিতে হয়, এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন করতে হয়। তৃতীয় সন্তান আরো বেশি ঝুঁকিতে থাকে। 

নবজাতকের জন্ডিস কি বড় হওয়ার পরে অন্য কোনো প্রভাব তৈরি করে?

জন্ডিসে আক্রান্ত হলে বিলিরুবিনের একটা মাত্রা আছে। প্রিম্যাচিউর শিশুর মাত্রা ১৮-এর বেশি হলে এবং ফুল টার্ম বেবির ২০-এর ওপরে চলে গেলে তখন সেটা ব্রেইনে চলে যায়। তা ব্রেইনের কিছু অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। এ পরিস্থিতিকে বলে কারনিকটেরাস। এমন পার্মানেন্ট ক্ষতি হয়ে গেলে আর ভালো হয় না। তখন শিশুর সেরিব্রাল পালসি হয়ে যায়। তাই শিশু জন্ডিসে আক্রান্ত হলে আমরা ফটোথেরাপি হোক বা এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন করে হলেও মাত্রা ২০-এর নিচে রাখার চেষ্টা করি। 

চিকিৎসার ক্ষেত্রে এর অবস্থা কী? জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কি এর চিকিৎসা করা যাচ্ছে?  

সবখানেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জেও এখন ফটোথেরাপি মেশিন আছে। উন্নতমানের মেশিন আমাদের আছে যেগুলো দিয়ে আমরা ফটোথেরাপি দিই। তাতে জন্ডিসটা কমে যায়। ব্লাড ট্রান্সফিউশনের রেটও এখন অনেক কম, রক্ত বদল আমরা করি না বললেই চলে। উন্নতমানের লাইট আসার পরে দেখা গেছে, সেটা দিলে দ্রুত জন্ডিস কমে যায়। এই লাইট খুব বেশি দামিও না। সেসব এখন সব জেলা-উপজেলা হাসপাতালে রাখা যেতে পারে। তবে জটিল জন্ডিসের চিকিৎসা সেখানে দেয়া কঠিন। 

নরমাল বা সিজারের ক্ষেত্রে কি কোনো পার্থক্য রয়েছে?

না, কোনো পার্থক্য নেই। কারণ এটি ডেলিভারির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। 

শিশুদের বিশেষায়িত চিকিৎসার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা কী কী রয়েছে?

সীমাবদ্ধতা অবশ্যই রয়েছে। কারণ আমাদের শিশু হাসপাতাল ৬০০-৭০০ বেডের হাসপাতাল। এখানে সিটি স্ক্যান বা এমআরআই মেশিন নেই। এটা একটা সীমাবদ্ধতা। এখানে আমাদের ১০০টি বেডের এনআইসিইউ, স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিট রয়েছে। কিন্তু তাতে আমরা বেশি শিশুর স্থান সংকুলান করতে পারছি না। তারা বিভিন্ন ক্লিনিকে যাচ্ছে। তখন তাদের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। নবজাতকের মেজর সার্জারি করার ক্ষেত্রে বেড সংখ্যার সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক রেয়ার ডিজিজের আমরা গ্রামগঞ্জে চিকিৎসা করতে পারি না। জন্মের পর শিশুর শ্বাসকষ্ট হলে নোয়াখালী থেকে ঢাকা আনতে হয়। ওখানে চিকিৎসা দিতে পারলে তাদের ঢাকা আসতে হতো না। গ্রামে এক্সপার্ট শিশু চিকিৎসক থাকলেও সেটআপ নেই। সেটা থাকা দরকার। এখন প্রতি উপজেলায় স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিট বা স্ক্যাবু করা হয়েছে। সেটাও বেশ দরকার ছিল। যদি জনগণ জানে যে সেখানে সবচেয়ে ভালো পরিবেশে ভালো চিকিৎসা দেয়া হয় তাহলে সবাই আশ্বস্ত হবে, ঢাকা আসার প্রবণতা কমবে। 

এখনো দেশে ২৫ শতাংশ শিশুর অপ্রাতিষ্ঠানিক জন্ম হচ্ছে। জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তারা কতটা ঝুঁকিতে আছে?

অপ্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারিগুলো দাই দিয়ে গ্রামে বেশি হচ্ছে। সেখানে তারা শিশু ডাক্তার পাবে না, যে জন্ডিসের মাত্রা নির্ধারণ করবে। বাবা-মা সেসব লক্ষ নাও করতে পারে। জন্ডিস যদি খুব বেশি হয় তাহলে তার খিঁচুনি শুরু হয়। খিঁচুনি বন্ধ করলেও সেই শিশুকে স্বাভাবিক করা যায় না। তখন তার সেরিব্রাল পালসি হয়ে যেতে পারে। তাই অপ্রাতিষ্ঠানিক সন্তানের জন্ম হলেও দেখতে হবে, তার জন্ডিস হচ্ছে কিনা, খিঁচুনি হচ্ছে কিনা, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা। অভিভাবককেই এসব খেয়াল করতে হবে। নবজাতকের বিপদ চিহ্ন খেয়াল করতে হবে। তার কোনো একটি দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। অস্ট্রেলিয়ায় বাবা-মাকে জন্মের আগেই ডামি সন্তান দিয়ে সন্তানের যত্নআত্তি শেখানো হয়। আমাদের দেশে সেটা নেই। তবে সবার সচেতন হওয়া দরকার। তাহলে শিশুমৃত্যুর হার আমরা কমিয়ে আনতে পারব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন