বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালিত

শক্তি ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকুক

গতকাল ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। জাতীয়ভাবে দিবসটি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। পূর্ণতা পায় বাঙালির বিজয়। ১৯৭১ সালের  ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ওই রাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর শুরু হয় বর্বর হামলা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। যুদ্ধে বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় মানুষ উদ্বেগাকুল চিত্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকে। বাঙালি জাতির প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন, কবে মুক্তি পাবেন, কবে দেশে ফিরবেন। সাধারণ মানুষ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের ভয়াবহতা, মানুষ হত্যা বিভীষিকার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে মনে করেছে শক্তি প্রেরণার উৎস হিসেবে, মুক্তি আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে। দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে সেটিই পূর্ণতা পায়।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির জন্য একটি বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন আত্মত্যাগের মাধ্যমে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাঙালি যখন বাস্তবতার মুখোমুখি তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যু যন্ত্রণা শেষে বঙ্গবন্ধু লন্ডন-দিল্লি হয়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফেরেন। তিনি ঢাকা এসে পৌঁছেন ১০ জানুয়ারি। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রাণবন্ত অপেক্ষায় ছিল। লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায়। বিকাল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন।

রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু সেদিন যে ভাষণ দেন, তা মার্চের ভাষণের মতোই মূল্যবান। বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় নেতাকে তাদের মধ্যে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। একটি নৈরাজ্যের মতো অবস্থা ছিল ২৫টি দিন। তিনি না এলে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিতে চাইতেন না সহজে। ভারতীয় সৈন্যও হয়তো অত তাড়াতাড়ি ফিরে যেত না। অনেক দেশের স্বীকৃতি পেতেও বেগ পেতে হতো। তার প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংহত হয়। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালি সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নির্দেশনা দিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত মন্ত্রমুগ্ধ জনতা দুই হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আক্ষরিক অর্থেই শুধু প্রত্যাবর্তন ছিল না, সেটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তিরও অঙ্গীকার।

দেশভাগের পর পরই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে আর সমান নজরে দেখতে পারে না। তারা অঞ্চলের মানুষকে বিভিন্নভাবে শোষণ আর বৈষম্যের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে, যার শুরু হয় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। এরপর একের পর এক ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোনো ষড়যন্ত্রই যে মেনে নেয়নি এবং প্রতিটি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে, তার পুরোভাগে প্রধান পুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন আমলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফার দাবি আদায়, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন একাত্তরের স্বাধিকার আন্দোলন, প্রতিটি আন্দোলনের প্রাণভোমরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু তার পুরো জীবনই অতিবাহিত করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে। শোষকের রক্তচক্ষুর রোষানলে পড়েছেন বারবার। বারবার তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তির আলোকবর্তিকা, অদম্য স্বপ্নবাজ বঙ্গবন্ধুকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। তার হাতেই শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন যাত্রা।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধানতম বা এক নম্বরের শত্রু ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির ব্যবস্থা করেছিলেন। সময় পৃথিবীর সঙ্গে ন্যূনতম সংযোগ ছিল না তার। কোনো খবরাখবর পেতেন না তিনি। কী ঘটে যাচ্ছে তার প্রিয় স্বদেশে, সে সম্পর্কে তার সামান্যতম কোনো ধারণা ছিল না বা সামান্যতম ধারণা পাওয়ার কোনো সুযোগও ছিল না। তার ওপর অকল্পনীয় মানসিক চাপ প্রয়োগ করেছিল, কিন্তু এত কিছুর পরও তিনি মুহূর্তের জন্যও জনগণের ওপর থেকে আস্থা হারাননি বা স্বাধীনতার সম্ভাবনা নিয়ে মনের অজান্তেও সন্দিহান হননি। জনগণের ওপর অবিচল আস্থা, স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন অঙ্গীকার, সংগ্রামের অজেয় চেতনা তাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ফাঁসির রজ্জুর হাতছানির মধ্যেও বেঁচে থাকার অফুরান সাহস জুগিয়েছিল। নিজ লক্ষ্যে অবিচল আস্থা বিশ্বাস রেখে তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এক অসম সুকঠিন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। সামগ্রিক পর্যালোচনায় কথা আজ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গড়ে ওঠায় তার স্বদেশভূমিতে ফিরে আসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার প্রত্যাবর্তন আমাদের স্বাধীনতাকে সবকিছু থেকে প্রভাবমুক্ত রাখতে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ তার নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে ভূখণ্ডগত, সংস্কৃতিগত, ভাষাগত প্রভাবগত সব বিবেচনায় যে আজ বিশ্ব মানচিত্রে এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কারণেই।

জাতির জনকের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করা এবং দেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তর করা। আমাদের তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন। তার প্রথম স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। আরেকটি স্বপ্ন যখন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছিলেন, তখনই বুলেটের আঘাতে সপরিবারে জাতির জনককে হত্যা করা হয়। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একপর্যায়ে হাল ধরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচক অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এগিয়ে চলেছে। যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন; দীর্ঘ পথপরিক্রমায় শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে অর্থনৈতিক সর্বসূচকে এগিয়ে। তবে এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন