পর্যালোচনা

বৈশ্বিক প্রভাব, আতঙ্ক এবং বাংলাদেশের করণীয়

আব্দুল বায়েস

সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক কনফারেন্সের আয়োজন করে যার শিরোনাম ছিলএকটা অনিশ্চিত এবং বিভাজিত বিশ্বে কভিড-উত্তর চ্যালেঞ্জসমূহ তিন দিনব্যাপী সম্মেলনেকভিড-পরবর্তী অনিশ্চিত বৈশ্বিক পরিবেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ওপর প্রবন্ধ পেশ করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ।

এটা সত্যি কথা চলমানঅনিশ্চিতএবংবিভাজিতবিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে বিদগ্ধ মহলে কানাঘুষা আছে, আছে স্বয়ং নীতিনির্ধারকদের মুখে পিলে চমকানো দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির হুঁশিয়ারি। দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক অস্থিতিশীল অবস্থা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ জনমনে চলমান উদ্বেগ এবং নীতিমালা প্রণয়নের পরিপ্রেক্ষিতে সাদিক আহমেদের নিবন্ধটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তথ্যভিত্তিক বিধায় পাঠকের সামনে এর সারমর্ম তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হলো।

এক.

লেখক সাদিক আহমেদ কিছু সুখবর দিয়ে শুরু করেছেন তার প্রবন্ধ। মাথাপিছু জিএনআই ১৯৭২ সালের ৮৮ ডলার থেকে ২০১৯- হাজার ২০৯ ডলার, একই সময়ে দারিদ্র্য হ্রাস (উঁচু রেখায়) ৮২ থেকে প্রায় ২২ শতাংশ, প্রত্যাশিত আয়ু বৃদ্ধি প্রায় ৪৫ থেকে ৭২ বছর, শিশু মৃত্যুর হাজারে ১৪০ থেকে ২২- হ্রাস ইত্যাদি ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভিযাত্রার গল্প বলার প্রয়াস লক্ষণীয়। সুখবর শেষ এখানেই নয়, তারপর ২০১৫ সালে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এবং ২০১৯ নাগাদ প্রবৃদ্ধির হার শতাংশ অর্জন যা বৈশ্বিক সর্বোচ্চের অন্যতম। সফলতার উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ সরকার ২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়নে আগ্রহী এবং ২০২০ সালের মার্চে গৃহীত দলিলে ২০৩১ সালের মধ্যে উঁচু-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর এবং চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

বিশ্বব্যাপী সব যখন ভালো চলছিল, ঠিক তখন নির্দিষ্ট করে ২০২০ সালের শুরুতে কভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বে মানব জীবন যেমন ধ্বংস হয়, তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ বেশ আঘাতপ্রাপ্ত হয় তবে উত্তর আমেরিকা কিংবা পশ্চিম ইউরোপের চেয়ে কম বিধ্বস্ত হয়েছিল। তার পরও এখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং স্বল্পকালীন দারিদ্র্য স্ফীত হয়। ২০২০ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের দশমিক শতাংশ থেকে দশমিক শতাংশে নেমে আসে; বিনিয়োগের হার ধীর গতি ধারণ করে রফতানি নিমজ্জিত হয়। করোনা ক্রান্তিকালে সরকারের নেয়া নীতি-হস্তক্ষেপ (policy interventions) খুব ভালো ফল দেয় বলে লেখকের বিশ্বাস এবং তার কিছু উদাহরণ তিনি উপস্থাপন করেন যেমন২০২১ নাগাদ রফতানি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে, বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাঠানো হয় এবং আমদানি তেজি ভাব ধারণ করে। বিশেষ করে সরকারি সাহায্যের সূত্রে পুঁজি প্রবাহের কারণে সার্বিক ভারসাম্য উদ্বৃত্ত দাঁড়ায়। ২০২১-এর জুন নাগাদ রিজার্ভ স্ফীত হয়ে দাঁড়ায় ৪৬ দশমিক বিলিয়ন ডলার এবং আগস্টে সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন, যা প্রায় সাড়ে সাত মাসের আমদানি মেটাতে পর্যাপ্ত বলে ধরে নেয়া যায়। মোটকথা জিডিপি বৃদ্ধি এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে থাকে; তখন নিম্নমুখী মূল্যস্ফীতির হার ছিল - শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে আশাবাদ উঁকি মেরে যেন বাংলাদেশকে জানাতে চায় সুদিন আসছে, ঘুরে দাঁড়াও বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি সম্পর্কে লেখক বলছেন, মানব-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে রাখা গিয়েছে এবং শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ আগের মতোই চলছিল।

দুই.

এমন কিছু ভালো অর্থনৈতিক ফলাফল হাতে নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ২০২২ অর্থবছরের জন্য একটা আগ্রাসী প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মধ্যে আছে সুদের হারের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে একটি বর্ধনশীল ঋণ নীতি যাতে করে ব্যক্তি বিনিয়োগ উৎসাহিত হয় এবং এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ঊর্ধ্বমুখী রাজস্ব ঘাটতিতে প্রতিফলিত একটা প্রসারণশীল রাজস্ব নীতি। এসবের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল - শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে প্রাক-কভিড গতিময়তা ফিরে পাওয়া।

কথায় বলে, ‘সবার কপালে নাকি সুখ সয় না বাংলাদেশে সেই আশায় এবং স্বপ্নে পানি ঢেলে দিতে উদ্যত হলো বহিঃস্থ খাতে উদীয়মান কিছু কালো মেঘ। অনিশ্চয়তার ঘোর অমানিশায় পড়ল বাংলাদেশ, যার ছয়টি নমুনা হাজির করেছেন লেখক: . কভিড কারণে ব্যাহত জোগান ব্যবস্থায় বিপত্তি; . উদীয়মান মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ; . ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ; . মার্কিন ডলারের উত্থান; . বৈশ্বিক সুদের হারের বৃদ্ধি এবং . আমেরিকা ইউরোপে মন্দার ঝুঁকি। লেখক খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন আলামতগুলো কোন পথে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে যদি না যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়।

লেখক উল্লেখ করছেন, জ্বালানির উচ্চমূল্য, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী মান, ঋণ নেয়ার ব্যয় বৃদ্ধি এবং রফতানির নিম্নগামী চাহিদাএসবের মিশ্রণে উন্নয়ন প্রতিবন্ধকতায় একটা কঠিন অবস্থানে পড়ছে বাংলাদেশ, যা নীতিনির্ধারকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অথচ মুখোমুখি হওয়ার নিমিত্ত প্রতিহতকারী পদক্ষেপের অভাবে অতিমারী থেকে উঠে আসার সফলতাটুকু ম্লান হতে পারে।

যেমন অধিকতর জ্বালানিমূল্য, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দামের জন্য আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ঋণ পরিশোধ খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রেমিট্যান্স রফতানির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। মোটকথা, চলতি হিসাবে বিরাট ঘাটতি, রিজার্ভ থেকে খরচ এবং ঋণ সেবা ব্যয় বৃদ্ধি সুখকর অবস্থান নির্দেশ করে না। স্বভাবতই, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ক্রান্তিকাল পার করছে, যেখানে কিছু কঠিন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ অন্যতম, যথা চলতি হিসাব ঘাটতি আকাশচুম্বী, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ৩০ শতাংশ রিজার্ভ ক্ষয়, স্বল্পকালীন ঋণ বৃদ্ধি এবং ত্বরান্বিত মূল্যস্ফীতি এবং আশঙ্কা করার কারণ আছে যে রফতানি হোঁচট খেতে পারে।

তিন.

বর্তমান সংকট উত্তরণে সরকার কর্তৃক গৃহীত কিছু নীতিগত-প্রতিক্রিয়া (policy response) তুলে ধরেন লেখক যেমন মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বহুধা বিনিময় হারের সূচনা, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, শুল্কের হার বৃদ্ধি, সার জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়ানো ইত্যাদি। তবে তিনি মনে করেন, রিজার্ভের ব্যাপক ধস এবং বহুধা বিনিময় হারের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্বল্পকালীন নাজুকতা তৈরি করতে পারে। তাছাড়া কর আদায়ে প্রচেষ্টা বৃদ্ধির অব্যাহত ব্যর্থতা বাজেট ঘাটতিতে ইন্ধন দিচ্ছে, ভর্তুকি বাবদ ব্যয় বড় হচ্ছে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় অপেক্ষাকৃত কম বিশেষত ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং আয় বিন্যাস উন্নিতকল্পে।

আরো দুটি সীমাবদ্ধতার কথা না বললেই নয়। চাহিদা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিপূর্ণ নীতি এখনো ঠিক করা হয়নি। এই ছয়-নয় বা নয়-ছয় সুদের হার মুদ্রানীতিকে অকার্যকর করে রেখেছে কারণ ঋণের চাহিদা সংকোচনে সুদের হার বৃদ্ধি দরকার অথচ মূল্যস্ফীতির হার শতাংশ পেরিয়ে গিয়েছে বলে ধারের হার প্রকৃত অবস্থায় ঋণাত্মক রয়ে যায়। লেনদেনের ভারসাম্যে এবং অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ কমাতে সরকারের উচিত এখনই ছয়-নয় সুদের হার নীতি থেকে সরে আসা। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিকল্পে পর্যাপ্ত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদাসীনতা বা অনিহা একদিকে রাজস্ব ঘাটতি উস্কে দিচ্ছে অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বাধাগ্রস্ত করছে। বিনিময় হারকে মুক্ত করতে পারলে রফতানি রেমিট্যান্সে ভর্তুকি কিংবা উৎসাহের প্রশ্ন ওঠে না।

প্রবৃদ্ধির গতিবেগ পুনরুদ্ধার প্রশ্নে সাদিক আহমেদের মন্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রবৃদ্ধির গতিবেগ সাধারণত মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন এজেন্ডা বলে বিবেচিত যা অব্যাহতভাবে পরিচালনা করা উচিত। কিন্তু স্বল্পকালীন সময়ে প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার মধ্যে ট্রেড অফ থাকতেই পারে। যেমন স্থিতিশীলতা আনয়নে চাহিদা কমাতে হতে পারে যা কিনা প্রবৃদ্ধির প্রতি বৈরী অর্থাৎ জিডিপি বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার শতাংশ নির্ধারণ করলে জুতসই অবস্থানে থাকা যায় এবং এটাকে পরাজয় বা পিছিয়ে আসা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফিরলে লেনদেনের ভারসাম্য ঘাটতি এবং মূল্যস্ফীতির মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির ওপর ব্যয়বহুল প্রভাব ফেলতে পারে এবং সেটা অধিকতর অপকারী হতে পারে।

যেহেতু মূল্যস্ফীতি ধনীর চেয়ে গরিবকে বেশি আঘাত করে, সেক্ষেত্রে রাজস্ব নীতি হওয়া উচিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় বাড়ানো। গরিব শ্রেণীর কাছে অধিকতর আয়-হস্তান্তর কর্মসূচি পৌঁছানো মূল্যস্ফীতির সময় মোক্ষম দাওয়াই।

চার.

পরিশেষে সাদিক আহমেদ মনে করেন আইএমএফ সুপারিশকৃত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার/পরিবর্তন তার প্রবন্ধে উত্থাপিত অনেক উদ্বেগের উপশম ঘটাতে সক্ষম হবে: বাজারভিত্তিক একই বিনিময় হার, ছয়-নয় সুদের হার নীতির অবলুপ্তি এবং ধারের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি এবং কর পদক্ষেপ, ভর্তুকি হ্রাস, সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি সমেত রাজস্ব নীতিকে কঠোর করা। মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, তিন বছর মেয়াদে আইএমএফ শুধু - বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে না বরং কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারকে সুপারিশ প্রদান করছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার করা না গেলে আইএমএফের - বিলিয়ন ডলার কোনো কাজে আসবে না।

 

আব্দুল বায়েস: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অর্থনীতির অধ্যাপক; বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন