পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-এ। দুর্ঘটনার দিন রোববার ২৫ জনের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল। প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়া আরো ২৫ মরদেহ গতকাল করতোয়া ও আত্রাই নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো প্রায় ৪০ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে। গতকাল রাত ৮টায় উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হয়। তবে আজ ভোর থেকে আবারো পুলিশের সহযোগিতায় অভিযান শুরু করবে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। পঞ্চগড়ের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক শেখ মো. মাহবুবুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, শুভ মহালয়ার দিনে দেবীপক্ষের সূচনায় বোদার বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হয়। তবে নদী পার হয়ে মন্দিরে যাওয়ার একমাত্র ভরসা নৌকা। প্রতি বছরের মতো দেবী আবাহনের উৎসবে যোগ দিতে মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় রোববার দুপুরে করতোয়ার বুকে ডুবে যায় পুণ্যার্থীদের বহন করা একটি নৌকা। নারী ও শিশুদের অনেকেই স্রোত ঠেলে তীরে আসতে পারেনি। তবে সাঁতরে প্রাণে বেঁচেছেন অনেকে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী থাকার কারণেই এ নৌকাডুবি।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর গ্রামের তারা রানী ওরফে লিপি রানীও উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল তার চার বছরের ছেলে বিষ্ণু বর্মণ, জা লক্ষ্মী রানী ও দেবরের তিন বছরের শিশু দীপঙ্কর বর্মণ। নৌকাডুবির পর তাদের কেউই আর বেঁচে ফেরেনি। স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে রবিন বর্মণ একেবারে নির্বাক। ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন রবিনের ছোট ভাই বাবুল বর্মণ। জানা যায়, পূজা দিতে লিপি রানী পরিবারের তিনজনকে নিয়ে নৌকায় ওঠেন। কিন্তু মন্দিরে পৌঁছানো তো দূরের কথা নদীই পার হতে পারেননি তারা।
মহালয়া উৎসবে যোগ দিতে রোববার সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন হরি কিশোর ও কনিকা রানী দম্পতি। এরপর আর তারা বাড়ি ফেরেননি। বাবা-মায়ের শোকে বারবারই জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তাদের দুই ছেলে। কান্নার জলে বাঁধ দিতে ব্যর্থ স্বজনদের সান্ত্বনাও। তবে হরি কিশোর আর কনিকা রানীর পরিণতি কী হয়েছে কেউ জানে না। মৃতদের ভিড়েও মেলেনি তাদের। তাই ফেরার অপেক্ষায় পরিবারটি। উদ্ধারকাজের দ্বিতীয় দিনে তাদের সঙ্গে জড়ো হন স্থানীয়রাও। নিহতের স্বজনদের আহাজারি আর মাতমে পুরো এলাকার পরিবেশ ছিল শোকার্ত।
এদিকে রোববার রাত ১১টা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চালিয়ে ২৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গতকাল ভোর থেকে পুনরায় উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মরদেহের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৫০-এ। এর মধ্যে ২৫ নারী, ১৩ শিশু ও ১২ জন পুরুষ। তারা হলেন হাশেম আলী (৭০), শ্যামলী রানী (১৪), লক্ষ্মী রানী (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫), শোভা রানী (২৭), দীপঙ্কর (৩), পিয়ন্ত (৩), রুপালি ওরফে খুকি রানী (৩৫), প্রমীলা রানী (৫৫), ধনবালা (৬০), সুনিতা রানী (৬০), ফাল্গুনী (৪৫), প্রমীলা দেবী, জ্যোতিশ চন্দ্র (৫৫), তারা রানী (২৫), সানেকা রানী (৬০), সফলতা রানী (৪০), বিলাশ চন্দ্র (৪৫), শ্যামলী রানী ওরফে শিমুলি (৩৫), উশোশি (৮), তনুশ্রী (৫), শ্রেয়সী, প্রিয়ন্তী (৮), সনেকা রানী (৬০), ব্রজেন্দ্র নাথ (৫৫), ঝর্ণা রানী (৪৫), দীপ বাবু (১০), সূচিত্রা (২২), কবিতা রানী (৫০), বেজ্যে বালা (৫০), দীপশিখা রানী (১০), সুব্রত (২), জগদীশ (৩৫), যতি মিম্রয় (১৫), গেন্দা রানী, কনিকা রানী, সুমিত্রা রানী, আদুরী (৫০), পুষ্পা রানী, প্রতিমা রানী (৫০), সূর্যনাথ বর্মণ (১২), হরিকেশর বর্মণ (৪৫), নিখিল চন্দ্র (৬০), সুশীল চন্দ্র (৬৫), যূথী রানী (১), রাজমোহন অধিকারী (৬৫), রূপালী রানী (৩৮), প্রদীপ রায় (৩০), পারুল রানী (৩২), প্রতিমা রানী (৩৯), বিষ্ণু (৩)।
স্থানীয়রা জানান, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা করতোয়া নদী উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় এমনিতে খুব খরস্রোতা নয়; গভীরতাও খুব বেশি নয়। কিন্তু গত দুদিনের টানা বর্ষণের পর উজানের ঢলে নদীতে পানি বেড়েছে অনেকটা। এর মধ্যে দুর্ঘটনায় পড়া নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ওঠায় এবং মাঝনদীতে নৌকাডুবির কারণে মৃত্যু এত বেশি হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। অর্থাৎ ৪০ থেকে ৫০ জনের ধারণক্ষমতার নৌকাটিতে চড়েছিল দেড় শতাধিক যাত্রী।
ঘটনার পর মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত জরুরি তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তা বোদা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইমরানুজ্জামান জানান, রাতে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা পর্যন্ত ৫০ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের তিনটি ইউনিট উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে। তবে বেশির ভাগ মরদেহ স্থানীয় ব্যক্তিরা উদ্ধার করেছেন বলে জানান তিনি।
দুর্ঘটনা তদন্তে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় জানান, উদ্ধার মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। অনেকে স্বজনদের মরদেহ খুঁজে পাওয়ার পর আমাদের অবহিত করেছেন। মরদেহ সৎকারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাথাপিছু ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য রেলপথমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। এ সময় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী নিহতদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন।