
সম্প্রতি এ বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে এতে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের পুঁজিবাজারে মুদ্রানীতির কী প্রভাব পড়তে পারে তা পর্যালোচনা করেছে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ লিমিটেড। এবারের মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে মিশ্র প্রভাব পরিলক্ষিত হতে পারে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
পুঁজিবাজারে মুদ্রানীতির প্রভাবের বিষয়ে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি পুঁজিবাজারকে সংকটময় অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে, যদিও এ পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। যদি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত নীতিগুলো সফল হয় এবং প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল অবস্থানে থাকে তাহলে সার্বিক অর্থনীতি উপকৃত হবে। আর অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রতিফলন হিসেবে এতে পুঁজিবাজারও উপকৃত হবে। রেপোর উচ্চহার ও অন্যান্য নীতি উদ্যোগ বাজারে অতিরিক্ত তারল্য কমিয়ে দিতে পারে এবং এতে সুদের হারের ওপর চাপ পড়বে। স্বাভাবিকভাবে উচ্চ সুদের হার এবং তারল্য সরবরাহ কমে গেলে শেয়ারের দরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটি যে নিশ্চিত ঘটবে তা নয়। বাজেটে যেসব প্রণোদনা দেয়া হয়েছে এবং করপোরেট কর কমানো হয়েছে তা দেশের ভোক্তা ও কোম্পানিগুলোর জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। যা বৈশ্বিকভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব কিছুটা প্রশমিত করতে পারে। এতে কোম্পানিগুলোর মুনাফার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। নতুন মুদ্রানীতির লক্ষ্য হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির মূল নির্দেশকগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। এর মধ্যে রয়েছে ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও বৈদেশিক মুদ্রার হার স্থিতিশীল রাখা। মনস্তত্ত্বনির্ভর হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে আত্মবিশ্বাস ফিরে এলে পুঁজিবাজারেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক বাজেট ও মুদ্রানীতি সরাসরি পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করবে না। তবে এটি চলমান কিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে সহায়তা করবে। এতে বাজারও উপকৃত হবে। অন্যদিকে সুদের হারের ওপর চাপ ও তারল্য নিয়ন্ত্রণের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে পুঁজিবাজারে। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অন্তর্নিহিত শক্তি যৌক্তিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে টাকার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক মান অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখাই মুদ্রানীতির মূল চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে ঘোষণা করা হয়েছে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাজারে টাকার সরবরাহ হ্রাসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য বাড়ানো হয়েছে নীতিহার হিসেবে বিবেচিত রেপোর সুদহার। দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে রেপোর সুদহার ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। জোর দেয়া হয়েছে আমদানি বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোয়। এজন্য নতুন নতুন পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিলাসপণ্য, বিদেশী ফল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টানতে এলসি মার্জিন বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে মুদ্রানীতিতে। মূল্যস্ফীতি ও টাকার মান ধরে রাখতে এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ১ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। যদিও গত দুই অর্থবছরেই এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে ছিল। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল ভূমিকায় থাকলেও সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলিত হয়েছে ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, কভিড-১৯-এর অনাকাঙ্ক্ষিত অভিঘাত ও ভূরাজনৈতিক সংকটে বর্তমান বিশ্ব এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। সফলভাবে কভিডের টিকাদান থেকে শুরু করে অন্যান্য কর্মসূচির কারণে যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, ঠিক তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ২০২১ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক পণ্যবাজার আরো বেশি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সর্বশেষ প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২২ সালে উন্নত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি হবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরো অঞ্চল ও ভারতের মতো অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথ অনুসরণ করেছে।