চলতি বছরের প্রথমার্ধ

ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধি

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা মহামারীসৃষ্ট ক্ষত কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে দেশের ব্যাংক খাত। চলতি বছরের প্রথমার্ধে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে জুন ছয় মাসে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশও ছাড়িয়েছে।

এবারো দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথমার্ধে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্যমতে, পরিচালন মুনাফার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সাউথইস্ট, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, মার্কেন্টাইল, প্রিমিয়ার, এনসিসি, ঢাকা, যমুনা, এক্সিম ব্যাংক ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে পরিচালন মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্সসহ (এসবিএসি) কয়েকটি ব্যাংকের। তবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, মধুমতিসহ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কিছুটা কমেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো গতকাল পর্যন্ত নিজেদের অর্ধবার্ষিকের হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি। এজন্য ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার চিত্র জানা সম্ভব হয়নি। কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক ৬০০ কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে বলে জানা গেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, মহামারীর বিপর্যয় কাটিয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতিতে ফিরেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে আমদানির পরিমাণ ইতিহাস তৈরি করেছে। একই সঙ্গে রেকর্ড রফতানিও হয়েছে দেশ থেকে। আমদানি রফতানি বাণিজ্যের কমিশন এবং ডলারের বাজারে বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কাজে লাগিয়েছে ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক ডলার বেচাকেনায় প্রত্যাশার চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণ আদায় পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বিষয়ে দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, তহবিল ব্যয় বাড়লেও চলতি বছরের প্রথমার্ধে সিটি ব্যাংক ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। আমাদের ব্যাংকের আমদানি রফতানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। করপোরেট ব্যাংকিংয়ে জোর না দিয়ে আমরা রিটেইল এসএমই খাতকে সম্প্রসারন করেছি। এর ইতিবাচক প্রভাব সিটি ব্যাংকের মুনাফায় পড়েছে। করোনাভাইরাসের অভিঘাত কমে আসায় দেশের অন্য ব্যাংকগুলোও ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে।

আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ কর-পরবর্তী মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা। গত ৩০ জুন ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের অর্ধবার্ষিকের আয়-ব্যয়ের হিসাব শেষ হয়েছে। তবে পরিচালন মুনাফা বাড়লেও বছর শেষে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা বাড়ার সম্ভাবনা কম। খেলাপি ঋণের চাপ সামলাতে গিয়ে দেশের অনেক ব্যাংকই বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের প্রথমার্ধে পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৫০৫ কোটি টাকা। চলতি বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ৬৫০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৫৭৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ব্যাংক এশিয়া। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৪৮৪ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৫৩৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ৪৭২ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফায় ছিল। চলতি বছরের প্রথমার্ধে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৯৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে ৩৫৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি।

সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামাল হোসেন বলেন, সাউথইস্ট ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে উন্নতির পথে রয়েছে। করোনার অভিঘাতে ২০২০ সালে আমরা কিছুটা চাপে ছিলাম। এখন চাপ কাটিয়ে আবারো সমৃদ্ধির পথে যাচ্ছে। আশা করছি, বছর শেষে সাউথইস্ট ব্যাংক ভালো মুনাফায় থাকতে পারবে।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২৮৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি ৪৯০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। ভালো করেছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকও। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটি ৪৬০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ৩১০ কোটি টাকা মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি। এক্সিম ব্যাংক চলতি বছরের প্রথমার্ধে পরিচালন মুনাফা পেয়েছে ২৮৫ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ২৫৫ কোটি টাকা ছিল। তবে পরিচালন মুনাফা কিছুটা কমেছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথমার্ধে ১৯৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছরের একই সময়ে ২০৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি।

জানতে চাইলে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, শক্তিশালী আর্থিক ভিতের দিক থেকে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান নেতৃস্থানীয়। ২০২০ ২০২১ সালে আমরা সম্প্রসারণের তুলনায় ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার প্রতি বেশি জোর দিয়েছিলাম। চলতি বছরে এর সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। আশা করছি, বছর শেষে আমরা শেয়ারহোল্ডারদের আরো ভালো সংবাদ দিতে পারব।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। সময়ে ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা পেয়েছে ৩৮৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে ৩০০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফায় ছিল প্রিমিয়ার ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথমার্ধে এনসিসি ব্যাংক ৩৭৫ কোটি এবং ঢাকা ব্যাংক ৩৬৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংক দুটির পরিচালন মুনাফা ছিল যথাক্রমে ৩১৫ ৩২১ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংক চলতি বছরে ৩৫০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। গত বছরের প্রথমার্ধে যা ছিল ২৮০ কোটি টাকা।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার আঘাত আমরা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ঢাকা ব্যাংকের আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্স, ঋণ আদায়সহ ব্যাংকের প্রতিটি সূচকে উন্নতি হয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।

বছরের প্রথমার্ধে ভালো পরিচালন মুনাফা করেছে ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক ১৮৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে ১৬৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি। এসবিএসি ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে, যা গত বছরের প্রথমার্ধে ছিল ৮০ কোটি টাকা। তবে পরিচালন মুনাফা কিছুটা কমেছে মধুমতি ব্যাংকের। গত বছরের প্রথমার্ধে ১২৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় থাকা ব্যাংকটি এবার ৮৩ কোটি টাকা মুনাফা করতে পেরেছে।

মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিউল আজম বলেন, ট্রেজারি বিভাগ থেকে আয় কিছুটা কমে যাওয়ায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে পরিচালন মুনাফা কম হয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মধুমতি ব্যাংক রক্ষণশীলতা ধরে রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। আমরা দ্রুত বড় হয়ে বিপদে পড়তে চাই না। বরং আর্থিক ভিত শক্তিশালী রেখে আমরা সমৃদ্ধির পথে যেতে চাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন