শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের একটি হতে চায় এনসিসি

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এর আগে তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি দেশের ব্যাংক খাতের নানা দিক নিয়ে তিনি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত 

কভিডকালে ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাতকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অতিমারীর সময়ে কেমন যাচ্ছে ব্যাংক খাত?

কভিডের কারণে আমাদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। কভিডের কারণে আমাদের এক-তৃতীয়াংশ জনবল শাখা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। যদিও সেবা কিন্তু কমানো হয়নি। প্রযুক্তির ব্যবহার করে কীভাবে গ্রাহককে সেবা দেয়া যায় সেটি শিখিয়েছে অতিমারী। শিক্ষাকে নিয়ে আমরা সামনের দিকে এগোতে চাই। এজন্য কৌশলগত পরিকল্পনা নিতে হবে। কীভাবে গ্রাহকসেবার ব্যয় কমিয়ে আরো ভালো করা যায় সেই চেষ্টা করছি। সামনের দিনগুলোয় আমরা প্রযুক্তিতে আরো বেশি বিনিয়োগ করব। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ গ্রাহক যারা রয়েছেন তারা কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে অভ্যস্ত। তাদের জন্য আমরা প্রচলিত ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করব। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম যারা কিনা প্রযুক্তির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল তাদের জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা ব্যাংকিং সেবাকে একেবারে হাতের নাগালে নিয়ে আসতে চাই। যাতে সেবা নেয়ার জন্য ব্যাংকে আসার প্রয়োজন না হয়। ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে নতুন আরো কী উদ্ভাবনী সেবা দেয়া যায় সেজন্য আমরা প্রধান কার্যালয়ে একটি ইনোভেশন সেন্টারও স্থাপন করেছি। কর্মীদের উন্নয়নেও আমরা কাজ করছি। কীভাবে কর্মস্থলকে আরো ভালো করা যায় সে চেষ্টা করছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অতিমারীর সময়ে অনেক ব্যাংক যেখানে জনবল কমিয়েছে আমরা সেখানে নতুন লোক নিয়েছি। কর্মীদের অনুপ্রাণিত করতে আমরা রিওয়ার্ড প্রদানের প্রচলন করেছি। সুশাসন পরিপালনের মাধ্যমে আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুশাসন মেনে চলছি। পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডার যারা রয়েছেন তাদের লভ্যাংশের মাধ্যমে ভালো রিটার্ন দেয়ার চেষ্টা করছি।

বিশ্বজুড়ে অতিমারীর আগে থেকেই ব্যাংকিং আর্থিক খাতের সেবায় উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অতিমারীর কারণেই প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। এটি আরো আগেই কেন করা সম্ভব হয়নি?

আমাদের এখানে একটা মনস্তত্ত্ব কাজ করত যে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং ধীরগতিতে এগোবে। কারণে দেখা গিয়েছে যে, অতিমারীর আগে ডিজিটাল ব্যাংকিং থাকলেও সেটি সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু কভিডের কারণে যখন লকডাউন চলে এল তখন বাধ্য হয়েই ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হয়েছে। কারণ এক-তৃতীয়াংশ জনবল শাখার মাধ্যমে সেবা দিতে হলে আপনাকে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতেই হবে। ফলে কভিডের কারণে দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের গতি বেড়েছে। এক্ষেত্রে যে পরিবর্তন পাঁচ বছরে হওয়ার কথা ছিল সেটি দুই বছরে হয়ে গেছে।

বছরের মার্চ প্রান্তিকেই ঋণ শ্রেণীকরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

অতিমারীতে সব খাতের ব্যবসা কিন্তু খারাপ করেনি। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, খাদ্য ডেলিভারির মতো খাতগুলো সময়ে ভালো ব্যবসা করেছে। অন্যদিকে হসপিটালিটি ব্যবসায় পুরোপুরি ধস নেমেছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার যে সুবিধা বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে সেটি কিন্তু সব খাতের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। ফলে সব খাতের ব্যবসায়ীরাই এর সুবিধা নিয়েছেন। এতে তাদের মধ্যে ঋণ শোধ করার ক্ষেত্রে জড়তা তৈরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাতকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করেই ঋণ নিয়মিত করার সুবিধা দিয়েছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের আদায় হয়েছে ৫৬ শতাংশ। চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই, কিন্তু এর মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। গত বছর আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দশমিক ৫৬ শতাংশ। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এটিকে শতাংশের নিচে নিয়ে আসা। বছর না হলেও সামনের বছরের মধ্যে এটি শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

আপনাদের ঋণ পোর্টফোলিও কোন কোন খাতে কেন্দ্রীভূত?

আমাদের ঋণ পোর্টফোলিও বেশ বৈচিত্র্যময়। ২০ শতাংশের বেশি কোনো খাতেই আমাদের ঋণ নেই। ওয়ার্ক অর্ডার ফাইন্যান্সিং, গার্মেন্ট বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। আমাদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতির কারণেই আমরা একক কোনো খাতে বেশি অর্থায়ন করি না।

কভিডের কারণে আপনাদের ব্যবসায় কোনো ছন্দপতন হয়েছে কি?

আমরা কোর ব্যাংকিং সিস্টেম পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম, যেটা কভিডের কারণে করতে পারিনি। বর্তমানে কোর ব্যাংকিং সিস্টেম পরিবর্তনের কাজ চলছে। রিটেইল খাতে আমাদের বিনিয়োগ কম রয়েছে, এটা বাড়াতে চাই। এসএমই খাতেও বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। কার্ডে আমরা আরো বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। এরই মধ্যে কার্ড সিস্টেম পরিবর্তনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করেছি। পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের একটি হতে চাই।

ঋণ আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়ার কারণে ব্যাংক খাতে কী প্রভাব পড়েছে?

যেহেতু আমাদের এখানে রেগুলেটেড মার্কেট, তাই আমাদের এটি পরিপালন করতে হবে। ১৯৯০-এর আগে মার্কেট কিন্তু ওয়েল রেগুলেটেড ছিল। এর পর থেকে ধীরে ধীরে লিবারাইজ হতে শুরু করল। সুদহার বাড়তে বাড়তে একটি পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতে হস্তক্ষেপ করেছে। প্রথমে কিন্তু শুধু ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। পরে আমানতের সুদের ক্ষেত্রেও হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যে সময় এটা করা হয়েছিল তখন এর প্রয়োজন ছিল। তবে যখন পরিস্থিতি তৈরি হবে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি উঠিয়ে নেবে বলে আমি মনে করি।

পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে সম্প্রতি বেশ আলোচনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী?

আমরা বরাবরই নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত সীমার মধ্যেই বিনিয়োগ করি। ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সুযোগ থাকলেও আমরা ২০-২১ শতাংশের বেশি করি না। তাছাড়া বিশেষ তহবিল গঠন করেও আমরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছি।

সামনের দিনগুলোয় আপনাদের কী ধরনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে?

আমানতে ২০২১ সালে দশমিক শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২২ সালে এক্ষেত্রে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রত্যাশা করছি। বছর আমরা ইসলামী ব্যাংকিং উইং চালু করতে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি পেয়ে গিয়েছি। তৃতীয় প্রান্তিকে এটা শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। ডিজিটাল ওয়ালেটের জন্য দরপত্র আহ্বান করছি। করপোরেট ব্যাংকিং চালুর চেষ্টা করছি। দেশে রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে আমরা নবম স্থানে রয়েছি। বছরের প্রথম প্রান্তিকে রেমিট্যান্সে আমাদের ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটি আরো বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। ২০২০ সালে আমাদের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ছিল ১৩ দশমিক , যা ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ১৫ দশমিক ৮৬। মূলধন পর্যাপ্ততার ভিত্তিতে আমরা অন্যতম শীর্ষ ব্যাংক। গত বছর আমাদের সম্পদের প্রবৃদ্ধি ছিল শতাংশ। বছর আমরা এটি ১১ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। আমরা নন-ফান্ডেড ব্যবসায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। গত বছর আমাদের আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৯ শতাংশ এবং রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ শতাংশের মতো। বছরের প্রথম প্রান্তিকে আমাদের আমদানিতে ২৮ শতাংশ রফতানিতে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বছর আমরা কমিশন ফি বাবদ আয় আরো বাড়াতে চাইছি। সব মিলিয়ে বছরটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সবাই পর্যবেক্ষণ করছে যে এটাই কভিড-উত্তর বছর কিনা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন