বিআইপির পর্যবেক্ষণ

রাজধানীর ৬৩ শতাংশ ওয়ার্ড ধারণক্ষমতা ছাড়িয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

অপরিকল্পিত অবকাঠামোর বোঝা কাঁধে নিয়ে যানজট আর জলাবদ্ধতার শহরে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। ভূমি ব্যবহারের যথাযথ নীতিমালা না মেনে গড়ে উঠেছে বহুতল আবাসিক বাণিজ্যিক ভবন। নগরীতে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত অবকাঠামোর শহরে প্রতি একরে জনঘনত্ব ৭০০ জনের কাছাকাছি। যদিও একটি আদর্শ মেগাসিটিতে জনঘনত্ব ধরা হয় প্রতি একরে ১২০ জন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক পর্যবেক্ষণের তথ্য বলছে, প্রতি একরে ৩০০ জন হিসেবে ঢাকায় ৬৩ শতাংশ ওয়ার্ডই ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে।

একটি বড় শহরের জনঘনত্বের জন্য মানদণ্ড ধরা হয় প্রতি একরে ৭০-৮০ জন, কেন্দ্রীয় শহর এলাকায় যা সর্বোচ্চ ১২০ পর্যন্ত হতে পারে। দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ঢাকায় ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২৯টি। সেই হিসেবে মূল ঢাকার ৯০ ভাগ এলাকা প্রতি একরে ১৫০ জনসংখ্যার মানদণ্ড অতিক্রম করেছে। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে এর চারপাশে চারটি স্যাটেলাইট শহর নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনও কাগজে বন্দি। ঢাকাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে শহর।

নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, জলাশয় নিম্নাঞ্চল ভরাট করে গড়ে ওঠা অপরিণামদর্শী উন্নয়নের ফলে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে রাজধানীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। অপ্রতুল সড়ক ব্যবস্থার কারণে বিপর্যস্ত পরিবহন খাতও। শহরের বাসিন্দাদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য একটি আদর্শ শহরের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন হলেও রাজধানীতে রয়েছে মাত্র শতাংশ। তার একটি অংশ আবার মোটরযান চলাচলের অনুপযোগী। কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট দুর্ঘটনা।

ঢাকা শহরের উন্নয়নে কার্যকর কোনো নীতিমালা না থাকায় যেখানে-সেখানে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ফলে ভূমির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ১৯৫৯ সালে মাস্টারপ্ল্যানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে শহর। নিয়ন্ত্রণে শৈথিল্যের কারণে শহরের অবকাঠামো উন্নয়নে তাও অনুসরণ করা হয়নি। ওই সময়ের তুলনায় এখন জনসংখ্যা বেড়েছে ৩০ গুণ। সে অনুযায়ী মাস্টারপ্ল্যান আধুনিকায়ন করা হয়নি, যার প্রভাব পড়েছে অন্যান্য উন্নয়নে। ঢাকা মহানগরীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১৬-৩৫) প্রণয়নের উদ্যোগ চলছে। তবে জনঘনত্বের যে হিসাব ধরে পরিকল্পনা করা হচ্ছে তা এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। ফলে শুরুতেই পরিকল্পনা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন পরিকল্পনাবিদরা।

ঢাকার যেখানে-সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসিক বাণিজ্যিক ভবন। সে অনুযায়ী সড়ক না থাকার কারণে যানজট বেড়েছে বহু গুণ। শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংস্থার প্রধান দপ্তর বিমানবন্দর পরোক্ষভাবে যানজট বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার নাজুক পরিস্থিতি উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিয়েছে ঢাকা শহরের অধিবাসীদের। যানজট কমাতে স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও মিলছে না তার সুফল। বরং এসব উদ্যোগ এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে নগরবাসীর। দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ছাড়া অবস্থা চলতে থাকলে একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময় সতর্ক করেছেন।

তারা বলছেন, স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পেও রাজধানী ঢাকা শহরের ক্ষতি তুলনামূলক বেশি হবে। রাজধানীতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। ফলে ভবনের সংখ্যাও বেশি। একই এলাকায় এত ভবন দেশের আর কোথাও নেই। ভূমিকম্প হলে এর একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।

ঢাকার অর্থনৈতিক গুরুত্বও বেশি। ঢাকা আক্রান্ত হলে গোটা দেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে।

বিষয়টি নিয়ে বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক . আদিল মুহাম্মদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান বিকাশ ঢাকামুখী জনমানুষের অভিগমনের তীব্র স্রোতের কারণে ঢাকার জনসংখ্যা জনঘনত্ব বর্তমানে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা ঢাকাকে চরমভাবে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। যার কারণে ঢাকার বায়ুমানের চরম অবনতি, যানজট, জলজট, পরিবেশদূষণ, শিল্পদূষণসহ বিভিন্ন সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। ঢাকার এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেক ওয়ার্ড সেই এলাকার ভার বহনক্ষমতার -১০ গুণ জনসংখ্যা বহন করে চলেছে। ফলে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা অতি নিম্নে নেমে এসেছে।

নগর পরিকল্পনায় জনঘনত্বের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিতে নাগরিক সুবিধাদি পরিষেবার বিপরীতে জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়েই সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। আধুনিক নগর পরিকল্পনায় শহরের জনসংখ্যা জনঘনত্ব নির্ধারণের পাশাপাশি উন্নয়নের তীব্রতা পরিমাপের মাধ্যমে নির্মিত পরিবেশের ওপর শহরের ভবন বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রভাব বিবেচনায় নেয়া হয়।

সামগ্রিক জনস্বার্থ জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এটি সহায়ক। বৈশ্বিক নগর পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও আমাদের দেশের নগর এলাকায় সঠিক পরিকল্পনার ধারণা এখনো সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য নগর এলাকার পরিকল্পনায় মৌলিক বিষয় অনুপস্থিত থাকায় শহরের বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীর ৬৫ শতাংশ এলাকাই একসময় বিভিন্ন ধরনের জলাশয় ছিল। বালি আবর্জনা দিয়ে তা ভরাট করে ফেলায় এসব এলাকার মাটির গঠন অত্যন্ত দুর্বল। নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ নিয়ম মেনেই এসব জায়গায় ভবন নির্মাণ করা উচিত। তা না হলে নির্মিত অবকাঠামো যেকোনো সময় বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ঢাকার ওপর চাপ কমানোর পরিকল্পনা আমাদের আছে। চাপ কমাতে ঢাকার চারপাশে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটিও বাস্তবায়ন করা হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে আমাদের পক্ষে সম্ভব সব রকম উদ্যোগই নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন