নিজ প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠা প্রধান নির্বাহীদের হাতে ব্যাংকের ঝুঁকি কম?

হাছান আদনান

এতদিন দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহী পদে দাপট ছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এএনজেড গ্রিন্ডলেজসহ বিদেশী ব্যাংক থেকে আসা ব্যাংকারদের। বেশি বেতনে অন্য ব্যাংক থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ দেয়া এক রকমের চল হয়ে উঠেছিল ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে। আশির দশক থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে বিদেশী ব্যাংকে চাকরি করা কর্মকর্তাদের চাহিদা ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে। বিদেশী ব্যাংকের পরিবর্তে এখন বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী পদে নিজেদের ব্যাংকের কর্মীদের বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। নিজেদের কর্মীকে এমডি পদে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি কিছু বেসরকারি ব্যাংকের চর্চা হয়ে উঠেছে।

নিজ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেছেন অথবা একই প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই দশক সময় অতিবাহিত করেছেন এমন ব্যাংকারদের মধ্যে যারা এরই মধ্যে এমডি-সিইও হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদেরই নিজ প্রতিষ্ঠানে বেড়ে ওঠা শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের শীর্ষ নির্বাহী পদে নিজেদের কর্মীরা নিয়োগ পাচ্ছেন। একই সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বেসরকারি খাতের দ্বিতীয় বৃহৎ ব্যাংক পূবালীতে। সব মিলিয়ে দেশের অন্তত নয়টি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী পদে নিজেদের কর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন। তালিকায় থাকা শীর্ষ নির্বাহীদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা, পূবালী ব্যাংকের এমডি শফিউল আলম খান চৌধুরী উত্তরা ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ রবিউল হোসেন। তিনজন শীর্ষ নির্বাহীর ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরুই হয়েছিল নিজ নিজ ব্যাংকে। ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে তারা একই ব্যাংকে চাকরি করছেন।

আবার ব্যাংকের মধ্যম স্তরের কর্মী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে শীর্ষ নির্বাহী পদে দায়িত্ব পেয়েছেন ব্যাংক এশিয়ার এমডি মো. আরফান আলী, ঢাকা ব্যাংকের এমডি এমরানুল হক, যমুনা ব্যাংকের এমডি মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন, এক্সিম ব্যাংকের এমডি . মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এমডি মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ব্যাংকে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন। ব্যাংকের মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে শীর্ষ নির্বাহী হয়েছেন। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে তারা দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকগুলো উন্নতি করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে আসা শীর্ষ নির্বাহীর চেয়ে নিজেদের ব্যাংকের কর্মকর্তাকে শীর্ষ নির্বাহী পদে নিয়োগ দেয়া যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই মঙ্গলজনক। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে যাকে নিয়োগ দেয়া হয়, তিনি ব্যাংককে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করেন। আবার কর্মীরাও শীর্ষ নির্বাহীকে নিজেদের লোক মনে করে বেশি আনুগত্য দেখান। ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য লোকও তৈরি হয় বলে মনে করছেন তারা।

প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের ব্যাংক খাত যতটা সম্প্রসারণ হয়েছে, সে তুলনায় দক্ষ জনবল গড়ে ওঠেনি। ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় এমডি ভাগিয়ে নেয়ার একটি অনৈতিক চর্চা ব্যাংক খাতে তৈরি হয়েছে। ঘন ঘন ব্যাংক পরিবর্তন করেন, এমন শীর্ষ নির্বাহীরা খেলাপি ঋণ বাড়ানো ছাড়া তেমন কিছু দিতে পারেননি। দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা কর্মকর্তার মধ্যে এক ধরনের মমত্ববোধ তৈরি হয়। ব্যাংকের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও তিনি জ্ঞাত থাকেন। শীর্ষ নির্বাহীসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব নেয়ার মতো দক্ষ কর্মকর্তা প্রতিটি ব্যাংকেই থাকা উচিত।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে শীর্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্রোতের বিপরীত ধারা সৃষ্টি হয়েছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের হাত ধরে। ১৯৮৩ সালে যাত্রা করা ব্যাংকটি দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রাখছে। দেশের ইসলামী ধারার অন্য ব্যাংকের কর্মীদের একটি বড় অংশের জোগানও দিয়েছে ব্যাংকটি। ২০০৮ সাল থেকে নিজেদের কর্মীদের শীর্ষ নির্বাহী পদে নিয়োগ দেয়ার সংস্কৃতি চালু করে ইসলামী ব্যাংক। এর পর থেকে চারজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংকটির নিজস্ব কর্মীদের থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এম ফরিদউদ্দিন আহমেদকে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের কর্মীদের শীর্ষ নির্বাহী পদে নিয়োগ দেয়া শুরু করে ইসলামী ব্যাংক। এরপর মোহাম্মদ আবদুল মান্নান মো. মাহবুব উল আলম ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন। দুজনেরই ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ইসলামী ব্যাংকে যোগদানের মাধ্যমে। সর্বশেষ ২০২১ সালের প্রথম দিন থেকে ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব পেয়েছেন মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। ১৯৮৬ সালে ব্যাংকটির প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি।

দীর্ঘ ৩৬ বছর একই ব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, নিজেদের কর্মীকে শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব দিতে পারা যেকোনো ব্যাংকের জন্যই গৌরবের। এতে প্রতিষ্ঠানও অপেক্ষাকৃত বেশি উপকার পায়। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে যিনি নিয়োগ পান তিনি ব্যাংকের নাড়িনক্ষত্র সবকিছুই জানেন। ফলে ব্যাংকের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে সাহসী ভূমিকা রাখতে পারেন। আবার কর্মীরাও প্রধান নির্বাহীকে নিজেদের একজন ভাবেন। ব্যাংকের কর্মীদের মধ্য থেকে শীর্ষ নির্বাহী বেছে নেয়া হলে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কর্মকর্তাও তৈরি হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়াও আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।

১৯৭৭ সালে পূবালী ব্যাংকে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন হেলাল আহমদ চৌধুরী। দীর্ঘ ২৯ বছর একই ব্যাংকে চাকরি করার পর ২০০৬ সালে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পান তিনি। তার নেতৃত্বে পূবালী ব্যাংক একটি শক্তিশালী আর্থিক কাঠামোর ওপর দাঁড়াতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। এরপর ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী। তিনিও পূবালী ব্যাংকেরই দীর্ঘদিনের কর্মী। এরপর ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব পেয়েছেন শফিউল আলম খান চৌধুরী। ১৯৮৩ সাল থেকে টানা ৩৯ বছর পূবালী ব্যাংকে চাকরি করছেন তিনি।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ব্যাংকে চাকরি করার বিষয়ে শফিউল আলম খান চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ৩৯ বছর ধরে আমি পূবালী ব্যাংক পরিবারের সদস্য। নিজের পরিবারের বাইরে ব্যাংকের প্রত্যেক সদস্যকে আমি স্বজন মনে করি। ব্যাংকের প্রতিটি বিষয় আমার নখদর্পণে ছিল। তাই শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি। আমার পরেও পূবালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব নেয়ার মতো যোগ্য কর্মী রয়েছেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে প্রায় দুই দশক আগে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে যোগ দিয়েছিলেন আবুল কাশেম মো. শিরিন। সময়জুড়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সাল থেকে ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহীর পদ সামলাচ্ছেন তিনি। তার নেতৃত্বে ব্যাংকটি আধুনিক প্রযুক্তিতে অগ্রদূতের আসনে উন্নীত হতে পেরেছে। একই প্রতিষ্ঠানের মধ্যম স্তরের কর্মকর্তা থেকে শীর্ষ নির্বাহীর পদে উন্নীত হওয়ার প্রসঙ্গে আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ডাচ্-বাংলা আমার ক্যারিয়ারের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। এটি ভালো লাগার বিষয় যে আমরা বড় হচ্ছি, ব্যাংকও বড় হচ্ছে। ব্যাংকের উদ্যোক্তারা কর্মীদের ওপর আস্থা রাখছেন। ফলে একদল দক্ষ যোগ্য কর্মী বাহিনী আমরা তৈরি করতে পেরেছি। আমার পরে ডাচ্-বাংলার নেতৃত্ব দেয়ার মতো অনেক যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন। নিজেদের মধ্য থেকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করতে পারা যেকোনো ব্যাংকের জন্যই বড় সাফল্য।

১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকা ব্যাংকে চাকরি করছেন এমরানুল হক। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানতে চাইলে এমরানুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, আমি ঢাকা ব্যাংকে একটি শাখার অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম। এরপর ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছি। নিষ্ঠার সঙ্গে এসব দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। ব্যাংকও আমাকে যোগ্য প্রতিদান দিয়েছে। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে আমার ওপর আস্থা রেখে ব্যাংকের পর্ষদ যে ভুল করেনি, সেটি এরই মধ্যে প্রমাণ করেছি।

দেশী-বিদেশী অন্তত এক ডজন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির অভিজ্ঞতা রয়েছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের। এর আগে তিনি ঢাকা ব্র্যাক ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্বও পালন করেছেন। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে নিজেদের কর্মী বেশি ভালো, নাকি অন্য ব্যাংক থেকে দক্ষ ব্যবস্থাপক নিয়ে আসা জরুরি? এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতার কর্মী থাকলে তাকে শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেয়া বেশি ভালো। তবে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের মধ্যেই উত্তরাধিকারী তৈরির পরিকল্পনা নেই। কারণে শীর্ষ নির্বাহীর হাল ধারার মতো দক্ষ যোগ্য লোক ব্যাংকে থাকে না। তখন অন্য ব্যাংক থেকে বিশেষজ্ঞ ব্যাংকার নিয়ে আসতে হয়। শুধু শীর্ষ নির্বাহী পদের জন্যই নয়, বরং যেকোনো ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরে যোগ্য কর্মী থাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা কর্মী নিজ ব্যাংক সম্পর্কে যতটা জানবেন, অন্য ব্যাংক থেকে নিয়ে আসা কর্মীর পক্ষে সেটি অর্জন করা সময় সাপেক্ষ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন