কেটে যাচ্ছে কভিডজনিত অভিঘাত

২০২১-এ রফতানি ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াচ্ছে

বদরুল আলম

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালজুড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ছিল মন্দা ভাব। সে তুলনায় ২০২১ সাল খুব নির্বিঘ্ন না হলেও বাজার ছিল তুলনামূলক চাঙ্গা। পণ্য আমদানি চাহিদায় দেখা গিয়েছে বড় উল্লম্ফন। বিশ্বজুড়ে পণ্য আমদানি চাহিদা বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে রফতানিনির্ভর বাংলাদেশে। এক বছরের ব্যবধানে ১০ মিলিয়ন ডলার বেড়ে বাংলাদেশের রফতানি ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ মোট হাজার ৯৩৩ কোটি ৭৩ লাখ বা ৩৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। এর পরের বছর অতিমারীর অভিঘাতে ১৫ শতাংশ কমে পণ্য রফতানি হয় হাজার ৩১৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের।

ইপিবির রফতানি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি হয়েছে হাজার ৯৭৫ কোটি ৩২ লাখ ডলার সমমূল্যের। সে হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে রফতানি হয়েছে ৩৬১ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের। শেষ মাস ডিসেম্বরেও এর চেয়ে কম রফতানি হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ শেষ চার মাস ধরেই রফতানি প্রবৃদ্ধি বজায় রয়েছে। যার হার নভেম্বরে ছিল ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ। ফলে ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালের ১২ মাসে রফতানি ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

অবশ্য গত ১২ মাসই যে রফতানি প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি ছিল তা নয়, পুরো বছরই প্রবৃদ্ধির হারে বেশ ওঠানামার চিত্র দেখা গিয়েছে। জানুয়ারি শুরুই হয় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দিয়ে। যা ২০২০ সালের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৯৯ শতাংশ কম। দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতেও রফতানিতে ছিল ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। তবে মার্চে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি হয় পণ্য রফতানিতে। যার হার ছিল ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

বছরের প্রথম প্রান্তিকের পর দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্ববাজারের আমদানি চাহিদায় বড় উল্লম্ফন দেখা যায়। ২০২০-এর এপ্রিলের তুলনায় ২০২১ সালের এপ্রিলে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় ৫০২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মে মাসেও ছিল বড় উল্লম্ফন। রফতানি প্রবৃদ্ধি মে মাসে ছিল ১১২ দশমিক ১১ শতাংশ। জুন মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি হলেও তা নেমে আসে ৩১ দশমিক ৭৭ শতাংশে।

২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে আবারো নেতিবাচক রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়। জুলাই মাসে আগের বছরের তুলনায় রফতানি কম হয় ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ। আগস্টে স্বাভাবিক রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়, যার হার ছিল ১৪ দশমিক শূন্য শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে আবারো বেড়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৩৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

গতকাল শেষ হওয়া চতুর্থ প্রান্তিকের প্রথম মাস অক্টোবরে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। নভেম্বর মাসে প্রবৃদ্ধি হয় ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ। ডিসেম্বর মাসে কম হলেও রফতানি প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় থাকবে বলে প্রত্যাশা করছেন রফতানিকারকরা। তাদের মতে, রফতানি ক্রয়াদেশে ভাটা পড়েনি। কাজেই শেষ মাস ডিসেম্বরেও রফতানিতে ন্যূনতম দুই অংকের প্রবৃদ্ধি হবে। যদি সারা বছরের গড় রফতানি ধরা হয় তাহলেও রফতানি ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি তাদের।

রফতানিকারকরা বলছেন, ২০২১ সালে পণ্য রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে এমন পরিকল্পনা ছিল। পরে বৈশ্বিক মহামারী বাস্তবতায় সেই লক্ষ্য ফিকে হয়ে যায়। তবে কভিড থেকে পরিত্রাণ না মিললেও আন্তর্জাতিক বাজার সক্রিয় হয়েছে। বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে ২০২২ সাল শেষে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে রফতানি। আর তা সম্ভব হবে রফতানি খাতের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাকের চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট পণ্য রফতানির ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক।

রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ২০২১ সালে শুধু পোশাক পণ্যের রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু মহামারীর প্রভাবে তা সম্ভব হয়নি। তবে কভিডের ধাক্কা সামলে ওঠা গেছে। ২০২১ সালে যা অনেকটাই স্পষ্ট ছিল। সরকারের সহযোগিতা কাজে লাগিয়ে ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা গেছে। এখন মূল্য চাপ সামলাতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কারণ উৎপাদন খরচ বেড়েছে ব্যাপক হারে। তার পরও রফতানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালেই ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বাংলাদেশের রফতানি খাত।

কভিডের প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবে ২০২০ সালের এপ্রিল নাগাদ প্রায় সোয়া তিন বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো বছরের রফতানিতে। ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে পোশাক রফতানি কমে যায় ১৭ শতাংশ। গতকাল শেষ হওয়া ২০২১ সালের ১১ মাসের রফতানি গড় বিবেচনায় নিলে সারা বছরে বৃদ্ধি পাবে বা প্রবৃদ্ধি হবে ২৫ শতাংশের বেশি। আর ২০২২ সালে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বছর শেষে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক না।

মূলত পোশাক খাতের ওপর ভর করেই ২০২১ সালে রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। পণ্যটির মোট রফতানির ৮০ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে। ২০২১ সালেও ধারা অব্যাহত ছিল। কভিডের অভিঘাত কাটিয়ে চাহিদা বৃদ্ধির প্রভাবে ২০২১ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরে ইউরোপের দেশগুলোতে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, কভিড-১৯-এর ছোবলে বিশ্বের অর্থনীতি পযর্দুস্ত ছিল ২০২০ সালজুড়ে। স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতির চাকাকে চলমান রাখতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তার উদ্যোক্তাদের। চরম প্রতিকূলতা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সরকার ঘোষিত সহযোগিতা নিয়ে পোশাক শিল্প মালিকরা টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। সেই প্রচেষ্টার প্রতিফলন দেখা গেছে ২০২১ সালে। ক্রয়াদেশেও দেখা গেছে উল্লম্ফন। ফলে কভিডের চরম অভিঘাত মোকাবেলা করতে পেরেছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাত। তবে নানা কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেশ চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যা কভিড থেকে পুনরুদ্ধারের পথকে কঠিন করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন