অভিমত

সেবামূলক কর্মকাণ্ডকে শিল্প ঘোষণা ও তার ফল

আবু তাহের খান

অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে industry শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদন, বাংলায় যার অর্থ হচ্ছে শিল্প অবশ্য বাংলায় শিল্প শব্দের অন্য একটি অর্থও রয়েছে, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে art; কিন্তু ১৯৯১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের শিল্পনীতিগুলোয় শিল্পের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে উল্লিখিত দুই অর্থের কোনোটিরই কোনো মিল নেই। অথচ ৩০ বছর ধরে অমিলটিই আত্মঘাতী হয়ে দেশের শিল্প খাতকে গোষ্ঠীবিশেষের সুবিধাভোগের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়ে এসেছে। বিষয়টি খোলাসা করা যাক।

১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব শিল্পনীতিতে শিল্পের সংজ্ঞা হিসেবে কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদনের কথাই বলা হয়েছিল, যা একটি বিশ্বজনীন সংজ্ঞা ধারণা। কিন্তু ১৯৯১ সালের শিল্পনীতিতে নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ডকে শিল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং উৎপাদনমূলক (ম্যানুফ্যাকচারিং) শিল্পের জন্য প্রযোজ্য রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা সুযোগ-সুবিধাদি সমহারে সেবাধর্মী কর্মকাণ্ডকেও দেয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়। অর্থাৎ অত্যন্ত জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ, সময়সাপেক্ষ বিনিয়োগঘন উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডকে দিনে কিনে দিনে বেচার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এক করে গুলিয়ে ফেলা হয়। ফলে দেশে উৎপাদনমুখী শিল্পের বিকাশই শুধু বাধাগ্রস্ত হয়নি, ব্যবসাকে শিল্প নাম দিয়ে এর সঙ্গে জড়িত চালাকচতুর সুবিধাবাদীরা অন্যায্য অনৈতিক পন্থায় নানা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করে নেয়। আর তা তারা কীভাবে নিয়েছে, সহজ বোধগম্যতার সুবিধার্থে এর কিছু উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো।

চলতি শিল্লনীতি ২০১৬-তে উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি যেসব অনুৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বিদেশে লোক পাঠানো, বিনোদন শিল্প, পর্যটন, প্রশিক্ষণ, ফটোগ্রাফি, টেলিযোগাযোগ, পরিবহন, ফিলিং স্টেশন, মান পরিদর্শন, সুপার মার্কেট, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ভবন পরিচ্ছন্নকরণ, নিরাপত্তা সেবা ইত্যাদি এবং এরূপ আরো ২০ ধরনের কর্মকাণ্ড। এখন বলুন, অন্তত চার-পাঁচ বছর সময় ব্যয় করে জমি কেনা, ভবন নির্মাণ, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি কাঁচামাল আমদানি, জনবল নিয়োগ প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি জটিল কাজের পেছনে বিপুল অর্থ শ্রম ব্যয় করে দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে স্থাপিত একটি উৎপাদনমূলক শিল্পের জন্য সরকারের কাছ থেকে যে প্রণোদনা পাওয়া যায়, ঘরদোর মোছার কাজের জন্যও যদি একই প্রণোদনা মিলে, তাহলে কোন মুখে আপনি উৎপাদনমুখী শিল্প স্থাপনের জন্য কাউকে পরামর্শ দেবেন? আর এমন উদ্যোক্তাই-বা কে আছেন, যিনি মুনাফার সহজ পথ ছেড়ে এমন কষ্টকর কাজে হাত দেবেন? না, বেশির ভাগ উদ্যোক্তা তা দেননি; বরং সহজ মুনাফার সেবামূলক কাজকেই তারা বেছে নিয়েছেন এবং আয়েশী আনন্দের সঙ্গে উৎপাদনমূলক শিল্পের সমান প্রণোদনা ভোগ করে চলেছেন। ১৯৯১ সালের পর থেকে গত ৩০ বছরে দেশে রাতারাতি যে নতুন বিত্তবান শ্রেণী গড়ে উঠেছে, তার পেছনে অন্যায্য কিন্তু সহজ রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ভূমিকা অনেকখানি। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, উল্লিখিত বিপুল প্রণোদনার অর্থ দেশের নিযুত-কোটি সাধারণ মানুষকেই জোগাতে হয়েছে এবং হচ্ছে।

উচ্চ শ্রমব্যয়, শিল্পসংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তরুণদের অনাগ্রহ অন্য নানা কারণে পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলো এখন কিছু উৎপাদনমূলক শিল্প স্থাপন থেকে পিছিয়ে আসছে। তারা হিসাব করে দেখেছে, এসব শিল্পে বিনিয়োগ করার চেয়ে সেসব শিল্পজাত পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করাটাই তাদের জন্য অধিকতর লাভজনক। আর সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশের জন্য ওই শিল্পগুলোই হচ্ছে ব্যাপকভাবে সম্ভাবনাময়। তাছাড়া ওষুধসহ আরো বেশকিছু বাংলাদেশী পণ্যের ব্যাপারে ডব্লিউটিওর (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা) সর্বশেষ শুল্ক নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে আরো বেশকিছু ধরনের উৎপাদনমূলক শিল্প স্থাপনেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেবা কার্যক্রমকে শিল্প ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সে সম্ভাবনার খুব সামান্যই কাজে লাগাতে পারছে। কারণ সেবামূলক কার্যক্রমের জন্য শিল্পের অনুরূপ প্রণোদনা সুবিধা বহাল থাকার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ উদ্যোক্তাই আর ঝুঁকি নিয়ে এবং কষ্ট করে উৎপাদনমুখী শিল্পের দিকে এগোতে চাইছেন না। তার পরও যে দু-চারজন সাহস করে সেদিকে যাচ্ছেন, সেটি একান্তই তাদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এক ধরনের উদ্যমী ইচ্ছাশক্তির কারণে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, দেশে যদি উৎপাদনমুখী শিল্পের একটি মৌলিক ভিত্তি গড়ে তোলা না যায় তাহলে বর্তমানে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে ধারা বহাল আছে, দীর্ঘময়াদে তা ঝুঁকিতে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

দেশে এসএমই (স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস) এখন একটি খুবই জনপ্রিয় অভিধা। চলতি শিল্পনীতিতে এটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তজ্জন্য কম সুদে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ নানা আর্থিক প্রণোদনা নীতিগত সহায়তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর এসব সুবিধা প্রদানের মৌল চেতনাটি হচ্ছে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পকে বাড়তি সুযোগদান। কিন্তু শিল্পনীতিতে এক্ষেত্রে শিল্পের পরিবর্তে এন্টারপ্রাইজ (এন্টারপ্রাইজ মানে শিল্প নয়, প্রতিষ্ঠান) উল্লেখ করার কারণে সব ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মালিকরাই এসব সুযোগ-সুবিধা সমহারে ভোগ করে চলেছেন। অথচ এটি পাওয়ার কথা ছিল উৎপাদনমুখী ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের। কিন্তু এখন সেটি হরেদরে মজুদদার থেকে দোকানি পর্যন্ত সবাই পেয়ে যাচ্ছেন। আর সেক্ষেত্রে প্রণোদনার জন্য প্রয়োজনীয় সমুদয় অর্থের জোগান দিচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পকে প্রণোদনাদানের কথা বলে জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে অবাঞ্ছিত করের বোঝা।

আর শিল্পের নাম করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সিংহভাগ প্রণোদনা যে আসলে সেবা খাতেই যাচ্ছে, তার দালিলিক প্রমাণ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন একক সমন্বিত প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনগুলোর তথ্য থেকে এটি খুবই স্পষ্ট যে শিল্পের নামে প্রদত্ত ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশই যাচ্ছে সেবা খাতে। একইভাবে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের নামে দেয়া ঋণের অন্তত ৬৫ শতাংশই গিয়েছে সেবামূলক কর্মকাণ্ডের পেছনে। আর এসব তথ্য এটিই প্রমাণ করে যে শিল্পের নামে সেবা খাতকে আর্থিক প্রণোদনা একদিকে যেমন উৎপাদনমুখী শিল্পকে অসম প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাতেই অন্যায্য পন্থায় গড়ে তোলা হচ্ছে একটি নতুন ধনিক শ্রেণী। বস্তুত, নব্য ধনিক শ্রেণীর হাত ধরেই দেশে অত্যন্ত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সম্পদবৈষম্য। আর সে সূত্র ধরে আলোচনাও এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে সমাজ থেকে সহসাই বৈষম্য কমাতে না পারলে উন্নয়নের সব আলোই বৈষম্যের অন্ধকারে ম্লান হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেবা খাতকে শিল্প নাম দিয়ে জনগণের কাছ থেকে সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার নীতি কাঠামোও অনেকখানি দায়ী বৈকি। ফলে সহসাই ধরনের ভ্রান্ত নীতির অবসান হওয়া প্রয়োজন।

প্রসঙ্গত বলি, ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ধামাকাসহ যেসব অনলাইন বিপণন কোম্পানি সাম্প্রতিক সময়ে নানা কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে, তাদেরও ঋণ অন্যান্য আর্থিক সুবিধাদি দেয়া হয়েছে শিল্প দেখিয়ে। ফলে কোম্পানিগুলো শুধু গ্রাহকের সঙ্গেই প্রতারণা করেনি, এরা রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের সম্পদেরও অপব্যবহার করেছে। তারা যে এটি করতে পেরেছে সেজন্য অনেকখানিই দায়ী সেবামূলক কার্যক্রমকে শিল্প হিসেবে ঘোষণাদান-সংবলিত ত্রুটিপূর্ণ ভ্রান্ত শিল্পনীতি।

শিল্পনীতিতে সেবামূলক কর্মকাণ্ডকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ফলে সমাজ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃষ্ট এরূপ নেতিবাচক ক্ষতিকারক প্রভাব প্রতিক্রিয়ার তালিকা এত দীর্ঘ যে নিবন্ধে সেটি পূর্ণাঙ্গ করা একেবারেই অসম্ভব। তবে এমন একটি ক্ষতিকর বিষয় কীভাবে, কেন, কার স্বার্থে, কাদের দ্বারা শিল্পনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হলো। ফলে গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরূপণের জন্য অবশ্যই স্বতন্ত্র গবেষণা হওয়া উচিত বলে মনে করি। অন্যদিকে যতটুকু জানা যায়, বর্তমান শিল্পনীতি সংশোধনের কাজ চলছে। প্রস্তাব হচ্ছে, ওই সংশোধনের সময় সেবামূলক কর্মকাণ্ডকে শিল্প হিসেবে ঘোষণাদানের ভ্রান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তটিও যেন সংশোধন করা হয়।

 

আবু তাহের খান: পরিচালক; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ; সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন