শ্রীলংকা

প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে মুর বণিকরা

বণিক বার্তা ডেস্ক

রাজনৈতিক যেকোনো ঘটনা এখন আতঙ্কিত করে তোলে লংকাদ্বীপের মুর ব্যবসায়ীদের ফাইল ছবি: বিবিসি

একসময় রত্ন মসলার ব্যবসার মধ্য দিয়ে বিশ্বজোড়া নাম করেছিল শ্রীলংকার মুর বণিকরা। হয়ে উঠেছিল লংকাদ্বীপের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। রাজধানী কলম্বোকে বাণিজ্যনগরী হিসেবে গড়ে তোলায় তাদের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে লংকান মুর বণিকদের আগের সে প্রাচুর্য সমৃদ্ধির দিনগুলো এখন অতীত হয়েছে। ঔপনিবেশিকদের নির্যাতন সহ্য করেও শতকের পর শতক ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রেখেছে তারা। শ্রীলংকার স্বাধীনতার পরও তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। সিংহলি জাতীয়তাবাদের উত্থান অস্তিত্বের সংকটে ঠেলে দিয়েছে তাদের। এখনো যেকোনো বড় রাজনৈতিক ঘটনায় সবার আগে শঙ্কিত হয়ে ওঠে লংকাদ্বীপের মুর বণিকরাই।

ঔপনিবেশিক পর্তুগিজরা শ্রীলংকার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অভিহিত করতো মুর হিসেবে। এখনো তাদের নামেই আখ্যায়িত করা হয়। ইতিহাস বলছে, শ্রীলংকায় মুরদের বসবাসের সূত্রপাত অষ্টম শতাব্দীতে। লংকাদ্বীপে বাণিজ্য করতে আসা আরব (সিরীয়, ইয়েমেনি) উত্তর আফ্রিকার বণিকদের অনেকেই স্থানীয়দের সঙ্গে বিয়েশাদি করে দেশটিতে স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিল। দশম শতাব্দীর মধ্যেই তারা হয়ে ওঠে সেখানকার বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলের সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ। তাদের মধ্যে অনেকেই নাম লেখায় মসলা রত্ন ব্যবসায়। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসা চালানোর পাশাপাশি তাদের কেউ কেউ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া একসময় দক্ষিণ ভারতীয় মুসলিম ব্যবসায়ীদের একাংশও শ্রীলংকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। লংকাদ্বীপের মুররা সবাই তাদেরই বংশধর।

লংকাদ্বীপে মুরদের প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। শ্রীলংকান মুর, ভারতীয় মুর লংকান মালয়। এর মধ্যে শ্রীলংকান মুরের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তবে মোটাদাগে সবাইকেই মুর নামে অভিহিত করা হয়। তাদের মুসলমান, মারাক্কালা, সিলোন মুরও বলা হয়। এছাড়া তাদের সোনাকার নামেও অভিহিত করা হয়। নামের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক ঐতিহ্যের সংযোগ রয়েছে বলেও কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন। শিয়া বোহরা সম্প্রদায় বাদে বাকি মুরদের প্রায় সবাই সুন্নি।

শ্রীলংকার মুরদের মধ্যে বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি নাম করেছিল মারাক্কায়া বোহরারা। তাদের মধ্যে মারাক্কায়ারা ছিল কলম্বোর নেতৃস্থানীয় বণিক। এছাড়া মারাক্কালারায়ারা নামে আরেকটি সম্প্রদায় রয়েছে, যাদের মূল ঐতিহ্য ছিল জাহাজের ব্যবসা।

একসময়ের সম্পদশালী মুররা এখন ক্ষয়িষ্ণু এক জনগোষ্ঠী। শতকের পর শতক ধরে ঔপনিবেশিক নিপীড়নের মধ্য দিয়েও ব্যবসার সঙ্গে সংযোগ ধরে রেখেছে তারা। কিন্তু সিংহলি জাতীয়তাবাদের উত্থান দিনে দিনে তাদের আরো প্রান্তিক করে তুলছে। আর সবার মতো এখনো গৃহযুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে তারা। গৃহযুদ্ধ শেষ হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে যেকোনো রাজনৈতিক ঘটনা এখন তাদের জন্য বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে।

সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ঘোষিত জরুরি অবস্থাও মুরদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। যদিও দেশটির সরকার বলছে, খাদ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ মজুদদারি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু বক্তব্যও আশ্বস্ত করতে পারছে না মুরদের। তাদের আশঙ্কা, জরুরি অবস্থার সুযোগে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তাদের আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। এর আগেও অসংখ্যবার এমন হয়েছে। শ্রীলংকা যখনই কোনো কারণে উত্তপ্ত বা অস্থিতিশীল হয়েছে, নিপীড়নের খড়্গ মুরদের ওপরই নেমে এসেছে সবার আগে। রাজাপাকসে পরিবারের শাসনামলে এর মাত্রা অনেক বেশি বেড়েছে। পরিবারটির শাসনের প্রধানতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে উগ্র সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে ইসলামোফোবিয়াও বেশ চরম আকার নিয়েছে।

বোধু বল সেনার (বিবিএস) মতো উগ্র সিংহলি সংগঠনগুলো বরাবরই মুরদের বিরুদ্ধে সিংহলিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে এসেছে। গোঁড়া ভিক্ষুদের উসকানি উত্তেজনাকে রূপ দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।

২০১৪ সালে শ্রীলংকার উপকূলীয় শহর আলুথগামায় বিবিএসের এক মুরবিরোধী সমাবেশ সহিংস হয়ে উঠলে তিন মুসলিম শ্রীলংকানের মৃত্যু হয়। লুট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয় মুসলিম মালিকানাধীন বেশকিছু দোকানপাট।

সিংহলিদের আরো খড়্গহস্ত হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিল কলম্বোয় ২০১৯ সালে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা। ওই বছরের ২১ এপ্রিল শ্রীলংকার তিনটি গির্জা তিনটি হোটেলে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় মৃত্যু হয় ২৭৭ জনের। আহত হয় চার শতাধিক। হামলার জন্য দায়ী করা হয় উগ্রপন্থী মুসলিম সন্ত্রাসীদের। এর জের ধরে শ্রীলংকার বেশ কয়েকটি স্থানে ওই সময় জাতিগত দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করেছিল।

মুরদের জন্য পরিস্থিতিকে আরো অসহনীয় করে তুলেছে মহামারীর প্রাদুর্ভাব। গত বছর দেশটির সরকার কভিডে মৃত মুসলিমদের মরদেহ দাহের নির্দেশ দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্দেশ বদলাতে বাধ্য হয় রাজাপাকসে সরকার। তবে এর ঠিক পর পরই মুরদের ধর্মীয় চিহ্নযুক্ত যেকোনো পোশাক পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

রাজাপাকসে সরকারের বৈষম্যপূর্ণ আচরণের ভিত্তিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজাপাকসের জরুরি অবস্থায় লংকাদ্বীপের মুরদের শঙ্কিত হয়ে ওঠার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দেশটিতে এখন সরকারবিরোধীদের পাশাপাশি মুরদের ওপরও জরুরি অবস্থার অপপ্রয়োগের ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে।

এর আগে গৃহযুদ্ধ চলাকালেও অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে শ্রীলংকার মুরদের। ওই সময় সিংহলি এলটিটিই উভয় পক্ষই মুরদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে শ্রীলংকার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশে মুরদের বন্দুকের মুখে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করে এলটিটিই। কেড়ে নেয়া হয় তাদের যাবতীয় সম্পদ। এর এক যুগ পর ২০০২ সালে এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ ওই ঘটনার জন্য শ্রীলংকান মুরদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

তবে লংকাদ্বীপের মুরদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তারা বাণিজ্যের পথ ছাড়েনি। ঔপনিবেশিক আমলেও বহিরাগত ইউরোপীয়রা তাদের বাণিজ্যিক প্রাধান্য স্থাপনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে মুর বণিকদেরই। পর্তুগিজদের হাতে ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে মুররা। ডাচ ঔপনিবেশিকদের আমলেও তাদের অনেক বৈষম্য অর্থনৈতিকভাবে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

শতকের পর শতক ধরে এত নিপীড়নের মধ্যেও মুর বণিকরা বাণিজ্যের পথ থেকে সরে আসেনি। প্রতিকূলতার মধ্যেই নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে তারা।

শ্রীলংকায় বর্তমানে মুরদের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। মূলত তামিলভাষী হলেও তাদের কথায় আরবি সিংহলির কিছুটা প্রভাব দেখা যায়। শুধু ধর্মীয় নয়, সংস্কৃতিগতভাবেও সিংহলি তামিলদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য ধরে রেখেছে তারা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন