অভিমত

আত্মপ্রত্যয়ী যুবকের প্রতিচ্ছবি

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

 আগস্ট ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের ৭৩তম জন্মদিবস। তিনি বেঁচে থাকলে এই দিনে তার বয়স ৭২ বছর পূর্ণ হতো। শহীদ শেখ কামাল ১৯৪৯ সালের আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার বড় বোন শেখ হাসিনা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

বাল্যকাল থেকেই শেখ কামাল ছিলেন দুরন্ত চঞ্চল প্রকৃতির। এক দণ্ডও কোনো জায়গায় স্থির থাকতেন না। তার বয়স যখন মাত্র কয়েক মাস, ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে তার পিতা রাজবন্দি হিসেবে জেলে যান। সেবার বঙ্গবন্ধু একনাগাড়ে দুই বছর তিন মাস, অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলে ছিলেন। স্বভাবতই শেখ কামাল শৈশবের সোনালি সময় পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু কিছুদিন টুঙ্গিপাড়ায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটান। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু বলেন, “একদিন সকালে আমি রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আরআব্বা’ ‘আব্বাবলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?’ আমি আর রেণু দুজনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল।

শেখ কামাল ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুলে পড়ালেখা করেন এবং ওখান থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যখন বাঙালি যুবক, কিশোর, ছাত্র, রাজনীতিক, পেশাজীবী, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য, সর্বস্তরের জনতা নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন শেখ কামাল সংগোপনে ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্স প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি নিযুক্ত হন। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন।

শৈশব থেকেই তার অনন্য প্রতিভা মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু তার সুযোগ্য সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সন্তানদের স্বাভাবিক স্নেহ, আদর শাসনে বড় করতে থাকেন। মা-বাবার সৎ স্বভাব নেতৃত্বের গুণাবলি সন্তানদের মধ্যেও বিকশিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বভাব গুণাবলির অনেক কিছুই শেখ কামালের মধ্যেও দেখা যায়। তিনি পিতার ন্যায় মিশুক, বন্ধুবৎসল, পরোপকারী খেলাধুলার প্রতি আগ্রহশীল ছিলেন। শাহীন স্কুল ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালে ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, ক্রিকেট, বাস্কেট বল প্রভৃতি খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সংস্কৃতির নানা দিকে তার দখল, খ্যাতি ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। ক্রিকেটে তিনি ছিলেন পেস বোলার, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্কেট বল টিমের অধিনায়ক, ফুটবল হকি খেলোয়াড়। ক্রীড়াক্ষেত্রে এরূপ বহুমুখী নৈপুণ্য সচরাচর দেখা যায় না। ১৯৭২ সালে তার হাতেই আবাহনী ক্রীড়া চক্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী মাইলফলক। তার চেষ্টা উদ্যোগে বাংলাদেশের ফুটবলে বিদেশী কোচ হিসেবে বিল হার্ট নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বাংলাদেশের ফুটবল ক্রিকেটের অগ্রগতির পেছনে সংগঠক হিসেবে শেখ কামালের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

শুধু খেলাধুলায়ই নয়, সংগীত, অভিনয়, বিতর্ক, বক্তৃতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছিল শেখ কামালের পারদর্শিতা। তিনি ছায়ানটে গান সেতার বাদন শিখতেন, ঢাকা থিয়েটারে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। শেখ কামালস্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীনামে বাংলাদেশের প্রথম পপ সংগীতের দল গঠন করেন, যেখানে দেশীয় সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের সংমিশ্রণ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যগোষ্ঠীতে ছিল তার সরব উপস্থিতি।

পর্যন্ত যা কিছু উল্লেখ করা হলো, তার অনেক কিছুরই আমি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। ১৯৭২ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে আমি ১৯৭৩-৭৪ সালে ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করি। ওই সময় শেখ কামালকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকটি সাংগঠনিক সভায় অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। জুনিয়র ছাত্রদের পিঠে হাত দিয়ে আদর করতেন, সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। ১৯৭৫ সালের মে-জুনে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন শেখ কামালদের ব্যাচ এমএ পরীক্ষা সমাপ্ত করে ছাত্রত্ব ত্যাগ করার পথে। তা সত্ত্বেও শেখ কামালকে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যেত, কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির ছেলে হিসেবে তার মধ্যে কোনো আলাদা অভিব্যক্তি, গরিমা বা অহংবোধ ছিল না। সহপাঠী ছাত্রছাত্রী, সিনিয়র-জুনিয়র সবার সঙ্গে ছিল তার আন্তরিক প্রাণখোলা মেলামেশা। তার বিভিন্নমুখী প্রতিভা প্রত্যক্ষ করে আমি অভিভূত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম দিনগুলোয় ক্লাসের চাপ না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কর্মকাণ্ড দেখার জন্য প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কাটাতাম। একদিনের কথা মনে আছে, সেদিন ছিল শেখ কামালদের ব্যাচের এমএ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদেরর্যাগ ডে ওই সময়েরর্যাগ ডে আনন্দ উৎসব, রঙ মাখামাখি ওই ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তা শালীনতার সীমা অতিক্রম করত না। পরবর্তী সময়ে অবশ্য র্যাগ ডে উৎসবের আতিশয্যে অন্যান্য শ্রেণীর ছাত্র, এমনকি পথচারীরাও উত্পীড়িত হতো। ফলে এটি অজনপ্রিয় হয়ে যায়। র্যাগ ডের বিকালে কলাভবন চত্বরে উন্মুক্ত মঞ্চে একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। বিদায়ী ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে অনুষ্ঠিত হলোট্যালেন্ট শো প্যারোডি গান, স্বরচিত কবিতা, উপস্থিত অভিনয়, কৌতুক, উপস্থিত বক্তৃতা, নৃত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকশিত করেন। শেখ কামাল অন্যদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে দর্শক-শ্রোতাদের আনন্দ দান করেন। তার সংস্কৃতি প্রতিভা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরব উপস্থিতি আমাকে
মুগ্ধ করে।

কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এসব অনুষ্ঠান তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করেছি। উপস্থিত বক্তৃতা অভিনয়ে শেখ কামাল প্রথম হন। এছাড়া সব অনুষ্ঠানেই তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত। বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা, কথা বলা, হাসাহাসি কোনো কিছুতেই তার কোনো অহমিকা, কৃত্রিমতা কিংবা গাম্ভীর্য ছিল না; যা রাষ্ট্রপতির ছেলে হিসেবে তার থাকতে পারত। তিনি ছিলেন তখন ছাত্রলীগের সংগঠক অভিভাবক, কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের সঙ্গেও তিনি একইভাবে মেলামেশা করতেন।

বাসায় সময় কাটাতেন কম, তবে যতটুকু সময় পরিবারের সঙ্গে কাটাতেন, তা ছিল পরিশীলিত হূদ্যতাপূর্ণ। মা-বাবার আদর্শ অনুসরণ ভাই-বোনদের সঙ্গে মূল্যবান সময়গুলো ছিল নানা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, গান-বাজনা গল্পগুজবে পরিপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হয়ে গেলেও শেখ কামালকে প্রায়ই ক্যাম্পাসে দেখা যেত। বেশির ভাগ সময়ই হাওয়াই শার্ট বা টি-শার্ট পরিহিত। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী অ্যাথলিট প্রথম নারী ব্লু সুলতানা কামাল খুকীকে বিয়ে করেন। খুকী তারই সহপাঠী ছিলেন। কলাভবনে ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টের পাশাপাশিই ছিল সোসিওলজি ডিপার্টমেন্ট। মাঝে মাঝে ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টের তিনতলায় স্ত্রী খুকীকে নিয়ে হেঁটে যেতেন। আমাদের মধ্য থেকে কেউকামাল ভাই, ভালো আছেন?’ বলে কথা বলতে চাইলে তিনি থেমে সস্নেহে করমর্দন করতেন, কাঁধে হাত রাখতেন এবং কুশল বিনিময় করতেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট উপস্থিত থাকবেন। সেজন্য আগে থেকেই সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে কোথায় এসে নামবেন, অনুষ্ঠানস্থলে কারা তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন, সাধারণ ছাত্ররা কোন দিকটায় থাকবে প্রভৃতি নির্ধারিত হয়েছে। আমরা কিছু বন্ধু-বান্ধব ঠিক করে রেখেছি  রাষ্ট্রপতি আসার বেশ কিছু সময় আগেই উপস্থিত হয়ে সুবিধামতো জায়গায় অবস্থান নেব। ১৪ আগস্ট বিকালেও শেখ কামালকে দেখা গেছে অনুষ্ঠানস্থলের আশেপাশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের লোকজনের সঙ্গে নানা খুঁটিনাটি তদারক করছেন।

১৫ আগস্ট সকালে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের সদস্যসহ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করার বিষয়টি শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে তা ছিল কল্পনারও বাইরে। ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে ঘাতকরা যখন বাড়িতে প্রবেশ করে তখন শেখ কামালই প্রথম বেরিয়ে আসেন কী হচ্ছে তার খোঁজ নেয়ার জন্য। ঘাতকরা তাকেই প্রথম ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। তারপর বঙ্গবন্ধুসহ একে একে পরিবারের সবাইকে গুলি করে বা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। নির্মমতা জাতির জন্য এক বিরাট কলঙ্ক হয়ে থাকবে।

শেখ কামাল তার প্রতিভা বিকাশের যতটুকু সুযোগ ২৬ বছরের জীবনে পেয়েছিলেন, তাতেই আঁচ করা গিয়েছিল পরবর্তী জীবনে তিনি দেশ জাতির জন্য কল্যাণকর আরো অনেক কিছু করতে পারতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই সম্ভাবনাময় তরুণকে হত্যা করা হলো। বনানী কবরস্থানে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। দেশের বাইরে জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে তার দুই বোন শেখ হাসিনা শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান।

পরবর্তী সময়ে জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য শহীদ শেখ কামালকে ১৯৯৮ সালে স্বাধীনতা পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। ২০১১ সালে তাকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান করা হয়।

প্রবাদপ্রতিম, কিংবদন্তি, সাহসী দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী যুবক ছিলেন শেখ কামাল। তার ৭৩তম জন্মদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন