শিক্ষাঙ্গনের দীর্ঘ ছুটিতে অকেজো হওয়ার ঝুঁকিতে গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি

ল্যাবগুলো সচল ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হোক

করোনার প্রলম্বিত ছুটিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষাঙ্গন বন্ধ। শ্রেণীকক্ষের মতো তালা ঝুলছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহারিক গবেষণা ল্যাবের দরজায়ও। এর ক্ষতি বিপুল। দীর্ঘদিন অব্যবহূত থাকায় গবেষণা ল্যাবের অনেক যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ছে। মেয়াদ হারাচ্ছে গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রচুর উপাদান। বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের ল্যাবগুলোর বেশকিছু যন্ত্রপাতি এরই মধ্যে অকেজো হয়ে পড়া এবং বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান সংগৃহীত অনেক নমুনা বিনষ্ট হওয়ার খবর মিলছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও একই চিত্র। গবেষণা বাড়াতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণাগার ল্যাবে সরকারিভাবে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। যন্ত্রপাতিগুলো দ্রুত অকেজো হয়ে পড়লে একদিকে বিনিয়োগের সুফল যেমন মিলবে না, তেমনি সেগুলো দ্রুত গবেষণা উপযোগিতা হারাবে। সর্বোপরি অনেকাংশে ব্যাহত হবে বিজ্ঞান কারিগরি বিষয়ের গবেষণা কার্যক্রমও। কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ল্যাবগুলো সচল করা এবং রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দ্রুত সক্রিয়তা কাম্য।

চলমান মহামারীতে সরাসরি বন্ধ থাকলেও অনলাইনে পাঠদান কিছুটা এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। অনলাইনে ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট নিয়মিতভাবে নেয়ার খবর মিলছে। অথচ বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারিক গবেষণা ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষকদের কেউ কেউ গবেষণা চালালেও সার্বিকভাবে গবেষণাগারগুলো সচল নেই। মূলত শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে শারীরিক উপস্থিতি না থাকায় সেগুলো খোলার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বলে জানা যাচ্ছে। এতে বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানাগারগুলোয় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ব্যবহার না হওয়ায় দামি যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক উপাদান, সংগৃহীত নমুনা এবং গবেষণা ফল বিনষ্ট হচ্ছে। একে তো শিক্ষার্থী শিখন-অর্জন হারানোর বিপুল ক্ষতি রয়েছেই, তদুপরি এই গবেষণাসংক্রান্ত অভিঘাতও কম নয়। নতুন যন্ত্রপাতি কেনা, উপকরণ সংগ্রহ এবং নতুন করে নমুনা সংগ্রহ বড় বিনিয়োগের বিষয়। আবার তা সময়সাপেক্ষও। প্রয়োজনীয় বরাদ্দের সংস্থান করতে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। অবস্থায় বিদ্যমান শিক্ষা সরঞ্জাম, ব্যবহারিক উপকরণগুলো যাতে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে না পড়ে, সেজন্য ল্যাবগুলো দ্রুত সচল করতে হবে। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দায়িত্বে নিয়োজিত কারিগরি কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট জনবলকে এক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে বৈকি।

বাস্তবতা হলো করোনাকালীন বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞান অনুষদ, বিশেষ করে জীববিজ্ঞান বিভাগ চিকিৎসাবিদ্যায় বরং লক্ষণীয় মাত্রায় গবেষণা বেড়েছে। বাংলাদেশে উল্টো চিত্র। করোনায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ল্যাবগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা হতাশাজনক। দীর্ঘদিন ব্যবহারের বাইরে থাকলে যন্ত্রপাতিগুলো অকেজো হয়ে পড়া এবং গবেষণার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হওয়াটা স্বাভাবিক। সেজন্য উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি অনেক উন্নয়নশীল দেশেও মহামারীর মধ্যে গবেষণা ল্যাবগুলো সচল রাখা হয়েছে। ভারতে উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেও পালাক্রমে চলছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবহারিক ল্যাব গবেষণা কার্যক্রম। এরই মধ্যে অনেক ক্ষতি হয়েছে। অন্য দেশগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের দেশেও গবেষণা ল্যাবগুলো সচল করা জরুরি। পালাক্রমে চালানো হলে লোকবলের উপস্থিতি যেমন কম হবে, তেমনি গবেষণা কার্যক্রমও অব্যাহত রাখা যাবে। সুতরাং পালার বিষয়টি আমলে নেয়া যেতে পারে।

শুধু গবেষণা নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতির বিষয়টি দেখতে হবে। সাক্ষরতা হার বৃদ্ধি, প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তিহার এবং ছেলে-মেয়ের ব্যবধান হ্রাসসহ বিগত বছরগুলোয় শিক্ষা খাতে আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন হয়েছে। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারী এসব অর্জনে নতুন করে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। করোনার কারণে অনেক শিক্ষার্থী আর স্কুলে না- ফিরতে পারে। দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই মা-বাবার সঙ্গে আয়বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত হবে। ফলে শিশুশ্রম ঝরে পড়ার হার বাড়বে। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকেই বাল্যবিবাহের শিকার এবং কিশোরীদের গর্ভধারণ বাড়বে। এতে শিশু মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে বাড়ার তথ্যও মিলছে। এটা উদ্বেগজনক। করোনার কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোয়ও শত শত পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক থেকে দেড় বছরের সেশনজট তৈরি হয়েছে। এর অভিঘাত বিশাল। সুতরাং শিক্ষা খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত এবং আমাদের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে যথাযথ পরিকল্পনা নেয়ার বিকল্প নেই।

দফায় দফায় শিক্ষাঙ্গন খোলার তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ৩০ জুন খোলার সম্ভাব্য তারিখ রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হবে কিনা, এটি অনিশ্চিত। কিছুদিন আগে বা পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই খুলে দিতে হবে। কিন্তু তার জন্য ভিত্তিমূলক কাজ করা জরুরি। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলা হলেও এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি সামান্য। এক্ষেত্রে আর শৈথিল্য কাম্য নয়।  

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক প্রস্তুতিমূলক কিছু কাজের ওপর জোর দিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরলে বা দূরশিক্ষণকালে শিক্ষার্থীদের শিখন ক্ষতির যথাযথ মূল্যায়ন অগ্রগতি তদারক করা, স্কুলে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখা নিশ্চিতে মনোসামাজিক সমর্থন প্রদান প্রয়োজনে পাঠ পুনরুদ্ধারমূলক ক্লাসের ব্যবস্থা করা, মহামারীকালীন বন্ধের দিনগুলো সমন্বয়ে শিক্ষা পঞ্জিকার পুনর্বিন্যাস, পাঠ্যক্রম অভিযোজন ভিত্তিমূলক শিক্ষায় প্রাধিকার প্রদান, চাপ সামলাতে শিক্ষকদের প্রস্তুত করা তাদের ডিজিটাল দক্ষতা বাড়াতে সমর্থন জোগানো, সহায়তা প্রয়োজন হওয়া শিক্ষার্থীদের চিহ্নিতপূর্বক তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া, স্কুল খোলার পরিকল্পনার সঙ্গে অভিভাবক, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বৃহত্তর কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা, ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীকে পুনরায় ভর্তি হতে উৎসাহিতকরণে বিশেষ জোর প্রদান, স্কুলে সংক্রমণ কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেয়া, টিকা গ্রহণ অন্য রোগবিদ্যাবিষয়ক নির্দেশনাগুলো অনুসরণে প্রচারণা চালানো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা, দূরশিক্ষণ জোরদার করতে সব ধরনের সহায়তা দেয়া এবং বাড়িতে পড়ালেখায় পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে সেখানে ডিজিটাল ডিভাইস, বই অন্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা, যাতে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা দূরশিক্ষণে পিছিয়ে না পড়ে। আমাদের মতো দেশের জন্য বিপুল শিখন ক্ষতির সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ভারসাম্য রাখার বিষয়টি সহজ নয়। সেই বিবেচনায় সংস্থাটির পরামর্শগুলো আমলে নিয়ে ভিত্তিমূলক কাজ এখনই শুরু করা সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন