প্রিমিয়ারকে গণমানুষের ব্যাংকে রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করছি

এম রিয়াজুল করিম দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিন বছরের বেশি সময় ধরে। এর আগে দীর্ঘ ৩৬ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে কাজ করেছেন দেশের প্রথম সারির একাধিক বেসরকারি ব্যাংকে। প্রিমিয়ার ব্যাংকসহ দেশের ব্যাংক খাতের নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

প্রতিষ্ঠার ২২ বছরে প্রিমিয়ার ব্যাংকের অর্জনগুলো কী?

প্রিমিয়ার ব্যাংকের ২২ বছরের পথচলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। যাত্রাকাল থেকেই ব্যাংকটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সারথি হয়েছে। অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে প্রিমিয়ার ব্যাংক পেয়েছে অন্তত এক ডজন দেশী বিদেশী পুরস্কার। গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে প্রিমিয়ার এখন দেশের প্রথম সারির একটি ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। আমাদের কাছে জমা আছে গ্রাহকদের ২৪ হাজার কোটি টাকার আমানত। শত শত উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে প্রিমিয়ার ব্যাংক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সমৃদ্ধিময় এক পথ খুলে দিয়েছে। গত দুই দশকে প্রিমিয়ার ব্যাংক নিজের জন্যও একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত তৈরি করতে পেরেছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের উচ্চপ্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা চলছে পাঁচ বছর ধরে। সময়ে ব্যাংকের প্রতিটি সূচকে আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। অতীতে প্রিমিয়ার ব্যাংক সিলেক্টিভ টাইপ (বাছাইকৃত) ব্যাংকিং করত। চার-পাঁচ বছর ধরে ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। রিটেইল, এসএমই, কৃষিসহ অর্থনীতির প্রতিটি খাতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আমরা বিনিয়োগ করছি। সাফল্যের সবটুকু অর্জনই সম্ভব হয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সর্বাত্মক সহযোগিতা কর্মীদের প্রচেষ্টায়। আমাদের সম্মানিত চেয়ারম্যান ডা. এইচবিএম ইকবালের লক্ষ্য হচ্ছে প্রিমিয়ারকে গণমানুষের ব্যাংকে রূপান্তর করা। আমরা সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছি।

তিন বছর ধরে প্রিমিয়ার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। সময়ে ব্যাংকটিতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে?

২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল আমি প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব গ্রহণ করি। দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার সময় ব্যাংকের সম্পদের আকার ছিল ১৮ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে প্রিমিয়ার ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ ৩০ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব নেয়ার সময় ব্যাংকের আমানত ছিল ১৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। বর্তমানে আমাদের আমানত ২৪ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। চলমান মহামারীর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর দিয়ে সুনামি বয়ে গেছে। তার পরও সবকটি সূচকে আমাদের অর্জন দৃঢ় অবস্থান প্রিমিয়ার ব্যাংককে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছে। করোনার বছরের জন্যও আমাদের পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ সাড়ে শতাংশ স্টকসহ মোট ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে বণিক বার্তা প্রতি বছর যে র্যাংকিং করে, তাতে প্রিমিয়ার ব্যাংক তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। শীর্ষস্থানে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি।

চলমান মহামারী দেশের ব্যাংক খাতের প্রযুক্তিগত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে সহায়তা করেছে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রিমিয়ার ব্যাংকের উদ্যোগ কী?

প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো দেশের যেকোনো ব্যাংকের জন্যই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সময়ের দাবি পূরণ করতে দেশের ব্যাংকগুলোও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। প্রিমিয়ার ব্যাংক এক্ষেত্রে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। ২৪ ঘণ্টা ব্যাংকিং সেবা দেয়ার জন্য আমরা এরই মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ কল সেন্টার চালু করেছি। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং মোবাইল অ্যাপের সুবিধা যুগোপযোগী করার পাশাপাশি সেবাগুলোর আওতা বাড়ানো হয়েছে। আমাদের মোবাইল অ্যাপপিমানি মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংক এমএফএস হিসাবে অর্থ স্থানান্তর, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং সেবা ঘরে বসে খুব সহজেই করা যাচ্ছে। কোর ব্যাংকিং সলিউশনসহ প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমরা বিস্তৃত পরিকল্পনা নিয়েছি। আমাদের অল্টারনেট ডেলিভারি আরো সম্প্রসারণ করেছি। আশা করছি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের গ্রাহকরা ঘরে বসেই সর্বোত্কৃষ্ট ব্যাংকিং সেবা পাবেন।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ব্যাংকের বিস্তৃতি বাড়ানোর লক্ষ্য আপনাদের পরিকল্পনা কী?

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে উপশাখা এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যকর ভূমিকা রাখছে। দুটি সেবার বিস্তৃতি বাড়ানোর মাধ্যমে প্রিমিয়ার ব্যাংককে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। উপশাখা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থনীতির মূলস্রোতে যুক্ত হচ্ছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ব্যাংকে আমানত রাখার সুযোগ পাচ্ছে। ব্যাংকগুলোও নিজেদের রিটেইল, এসএমই কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারবে। এখনো ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর কাছে প্রিমিয়ার ব্যাংক পৌঁছতে চায়। পাশাপাশি নতুন নতুন প্রডাক্ট উদ্ভাবন চালুর মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবাকে আরো বেশি গ্রাহকবান্ধব করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।

দেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা ভালো মনে হলেও অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। কয়েক বছর আগে যে বিনিয়োগ খরা শুরু হয়েছিল, তা তীব্রতর হয়েছে করোনার আবির্ভাবে। বছরগুলোতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক অর্জন থাকলেও বিনিয়োগ পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়েনি। সরকারি বিনিয়োগের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ার কথা থাকলেও বাস্তবে সেটি ঘটেনি। বিনিয়োগের স্থবিরতার জন্য অবকাঠামোর অপ্রতুলতা, পুঁজিবাজারের অদক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানাবিধ কারণ দায়ী। বিদেশী বিনিয়োগ পরিস্থিতিও বিগত বছরের তুলনায় অনেক কমে গেছে।

করোনা-পরবর্তী ব্যাংক খাত হবে বেশ চ্যালেঞ্জিং। সব ধরনের সুদের হারে সীমারেখা দেয়ার ফলে ভোক্তাঋণ অন্যান্য রিটেইল ব্যবসায় ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কমে যাবে। পদ্ধতিগতভাবেই এসব ঋণের পরিচালন খরচ বেশি। ভোক্তাঋণের প্রবাহ কমে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অভ্যন্তরীণ শিল্প। বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা পড়ার কারণে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে বিপাকে আছে, যার অভিঘাত গিয়ে পড়ছে সাধারণ মধ্যবিত্ত আমানতকারীদের ওপর। কারণ ব্যাংকগুলোকে খরচ কমানোর জন্য অন্য পদক্ষেপের সঙ্গে আমানতের সুদহার আরো কমাতে হবে। যদিও আমানতের সুদহার বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়েও কম। 

করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ডেফারেল সুবিধা বা অতিরিক্ত সময় দেয়া হয়েছে। আগামীতে টাকা আদায়ের সম্ভাবনা কতটুকু?

ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় দেয়া হলেও কিছু ভালো গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছেন। খেলাপি ঋণের মধ্যে বেশির ভাগই মন্দ মানের। এর প্রধান কারণ পুনর্গঠনকৃত ঋণ আদায় না হওয়া। এসব ঋণের এক কিস্তি পরিশোধ না হলেই মন্দ মানের খেলাপিতে রূপান্তর হয়। ঋণখেলাপিদের মনে এটি গেঁথে দেয়া দরকার যে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাতিলের ধারা যুক্ত করা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছি। অর্থঋণ আদালতে বন্দি টাকাগুলো কার্যকরভাবে ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। অনেক ধরনের আইনই আছে, কিন্তু কোনোটাই ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এসব আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় করা সহজ হবে। আমরা অর্থঋণ আদালতের কাছে যাই, কিন্তু সময়সাপেক্ষ হওয়ার কারণে বেরিয়ে আসতে পারি না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন