ভ্যাকসিন প্রিন্স সিংহাসনচ্যুত হতে চলেছেন?

বণিক বার্তা ডেস্ক

বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। টিকার উৎপাদন সক্ষমতা বাজার দখলের দিক থেকে বিশ্বের অন্য সব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এগিয়ে সেরাম ইনস্টিটিউট। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস পুনাওয়ালার ছেলে বর্তমান প্রধান নির্বাহী সাইরাস পুনাওয়ালাও নিয়ে এতদিন বেশ গর্ব করেছেন। নিজেকে দাবি করেছেন ভ্যাকসিন প্রিন্স হিসেবে।

তথ্য মতে, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি বছর প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগের প্রায় ১৫০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরেও বর্তমানে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত কভিড-১৯-এর টিকা উৎপাদন করছে সেরাম। টিকা বর্তমানে দৈনিক গড়ে ২০ লাখ ডোজ উৎপাদন করছে সেরাম। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ২২৫ কোটি ডোজের কাছাকাছি।

তবে টিকা উৎপাদন সক্ষমতায় প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষস্থান এখন হুমকিতে। চলমান মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে চীনের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলেছে। দেশটির শীর্ষ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক বায়োটেক জানিয়েছে, এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টিকা উৎপাদন সক্ষমতা আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির তৃতীয় টিকা উৎপাদন ফ্যাসিলিটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টিকা উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ডোজে। সক্ষমতা আরো বাড়ানো হবে বলে দেশটির স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে সিনোভ্যাক বায়োটেক সেরাম ইনস্টিটিউটকে টপকে শীর্ষস্থানে চলে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপের (সিনোফার্ম) বার্ষিক টিকা উৎপাদন সক্ষমতা ১১০ কোটি ডোজ। সিনোফার্ম জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির মোট টিকা উৎপাদন সক্ষমতা ৩০০ কোটি ডোজে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে কতদিনের মধ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।

মূলত দুই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বছর শেষ হওয়ার আগেই ৩০০ কোটি কভিড-১৯-এর টিকা উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে চীন। দেশটির ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের কর্মকর্তা ঝেং ঝোংওয়েই গতকাল সিচুয়ান প্রদেশের চেংদু শহরে এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন। বর্তমানে তিনি চীনের কভিড-১৯ টিকা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন।

অন্যদিকে সেরাম ইনস্টিটিউটও বর্তমানে নিজস্ব টিকা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত করোনার টিকার অর্ধেকই উৎপাদন হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতসহ উন্নয়নশীল স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধও ছিল সেরাম। কারণে চলমান মহামারী পরিস্থিতিতে এসব দেশে আদর পুনাওয়ালাকে দেখা হচ্ছিল অনেকটা পরিত্রাতার চোখে। তার কাছ থেকে অনেক প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছিল টিকাগ্রহীতা দেশগুলোর।

তবে বর্তমানে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না আদর পুনাওয়ালা। সেরাম থেকে বিশ্বের অনেক দেশেই এখন টিকা সরবরাহ বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটি নিজেও পড়েছে বিপাকে। চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারায় এরই মধ্যে সেরামকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছে টিকার উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এর কারণ হিসেবে আদর পুনাওয়ালা বলছেন, চলমান মহামারী পরিস্থিতিতে টিকার চাহিদা অনেক বেড়েছে। চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে সরবরাহের সক্ষমতা সেরামের বর্তমানে নেই। সক্ষমতা বাড়াতে হলে এখন প্রচুর অর্থ প্রয়োজন।

এজন্য ভারত সরকারের কাছে হাজার কোটি রুপি অনুদানও চেয়েছেন তিনি। আদর পুনাওয়ালার ভাষ্যমতে, নয়াদিল্লি থেকে যদি অনুদান না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে তাকে বিকল্প উেস হাত বাড়াতে হবে। বিকল্প উৎস হিসেবে বর্তমানে ব্যাংকঋণ সরবরাহ চুক্তির বিপরীতে পাওয়া অগ্রিম অর্থ কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন তিনি।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহ শুরু করে সেরাম। এখন পর্যন্ত ভারতে প্রতিষ্ঠানটি টিকা সরবরাহ করেছে ১০ কোটি ডোজের বেশি। এছাড়া কোভ্যাক্স জোটভুক্ত দেশগুলোয় টিকা সরবরাহ করেছে আরো প্রায় তিন কোটি ডোজ।

তবে সেরামের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোভ্যাক্স জোটভুক্ত দেশগুলোয় এতদিনে আরো চার কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের কথা। চলতি বছরের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে সেরামের টিকা রফতানি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মোট সক্ষমতার ৬০ শতাংশ। কিন্তু মার্চ থেকে ভারতে সরবরাহে অগ্রাধিকার দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পুনাওয়ালা এখন বলছেন, উৎপাদনের অর্ধেক রফতানি করতে তার আরো দুই-তিন মাস লেগে যেতে পারে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উৎপাদিত টিকা কোভিশিল্ড নামে বাজারজাত করছে সেরাম। এছাড়া বর্তমানে নোভাভ্যাক্স উদ্ভাবিত কোভোভ্যাক্স উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। টিকা বাজারে আসতে পারে আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকার কাঁচামাল রফতানিতে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রয়েছে। অবস্থায় চাহিদামাফিক কোভোভ্যাক্স উৎপাদন করতে পারা নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া রাশিয়ায় উদ্ভাবিত স্পুটনিক ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথাও ভাবছে সেরাম। এজন্য আরআইডিএফ নামে একটি রুশ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে আলোচনা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সেক্ষেত্রে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় নিতে পারে আরো এক-দুই মাস।

টিকা সরবরাহ নিয়ে বর্তমানে ভারতের বাইরের দেশগুলোয় বেশ ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে সেরাম। অন্যদিকে অর্থের সংকট যোগ হয়ে পরিস্থিতি হয়ে পড়েছে আরো লেজেগোবরে পরিস্থিতির জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তিকে দায়ী করছেন আদর পুনাওয়ালা। সম্প্রতি ভারতীয় এক গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, (ভারত) সরকারের অন্যান্য দেশে কোভিশিল্ড রফতানি স্থগিত করে দেয়া এবং ভারতের সঙ্গে প্রথম অধিকার চুক্তির বিষয়টি অন্য দেশগুলোকে বোঝানো মুশকিল। এসব দেশেই টিকাটি অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। গোটা বিশ্বেরই এখন টিকা দরকার। মুহূর্তে আমরা ভারতের প্রয়োজনকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি এবং এখনো আমরা যেসব ভারতীয়ের টিকা প্রয়োজন, তাদের সবাইকে টিকা প্রয়োজনমাফিক সরবরাহ করতে পারছি না।

ভারত সরকারের সঙ্গে শুরুতেই অগ্রাধিকার চুক্তি করা হলেও আদর পুনাওয়ালা বলছেন, এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে সেরামের আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আগে কোনো পরিকল্পনা বা বাজেট করা হয়নি। কারণ আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা আগে রফতানি করব এবং সে রফতানি থেকে পাওয়া অর্থ থেকেই তহবিল তৈরি করব। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না। আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে এখন আরো পথ উদ্ভাবনের দিকে এগোতে হবে।

সেরাম ইনস্টিটিউট বর্তমানে দৈনিক ২০ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড উৎপাদন করছে। ভারত সরকারের কাছে টিকাটি প্রতি ডোজ ১৫০ রুপিতে বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়ে পুনাওয়ালার ভাষ্য হলো, আমরা ভারতে প্রায় ১৫০-১৬০ রুপি দরে সরবরাহ করছি, যেখানে এর গড় মূল্য প্রায় দেড় হাজার রুপি। মোদি সরকারের অনুরোধে আমরা ভারতে ভর্তুকি মূল্যে টিকাটি সরবরাহ করছি। তার মানে এই না, আমরা এখান থেকে কোনো মুনাফা করছি না। কিন্তু পুনর্বিনিয়োগের জন্য যেটা প্রয়োজন; ব্যাপক মুনাফা (সুপার প্রফিট); সেটা আমরা করতে পারছি না।

তিনি বলেন, এখন আমাদের প্রয়োজন প্রায় হাজার কোটি রুপি এবং এটিসহ গোটা প্রক্রিয়ায় সময় প্রয়োজন ৮৫ দিন। অর্থাৎ আমাদের উৎপাদন কার্যক্রম বাড়াতে সময় প্রয়োজন আরো তিন মাস।

করোনার টিকা উৎপাদন শুরুর আগে সেরাম ইনস্টিটিউট প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১৫০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করেছে। বাজারে পোলিও থেকে শুরু করে ডিপথেরিয়া, ধনুষ্টংকার, বিসিজিহেপাটাইটিস বি, এমএমআর (হাম, মাম্পস রুবেলা) ইত্যাদি প্রতিষেধক সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। টিকার ব্যবসার সুবাদে ভারতের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে উঠে এসেছে পুনাওয়ালারা। টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, পরিবারের মোট সম্পদ মূল্যায়িত হয়েছে দেড় হাজার কোটি ডলার (প্রায় লাখ ১২ হাজার ৮৮ কোটি রুপির সমপরিমাণ। বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় লাখ ২৬ হাজার ৮২৩ কোটি)

সম্পদশালী পরিবারের সন্তান হিসেবে আদর পুনাওয়ালার জীবনযাপনও বেশ বিলাসী। ২০১৫ সালে তার পরিবার মুম্বাইয়ে লিংকন হাউজ নামে একটি ভবন ক্রয় করে। এতে ব্যয় হয়েছিল ১১৩ কোটি ডলার (৮৪৪ কোটি রুপির বেশি) ভারতের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত দামে আর কোনো ভবন বিক্রি হয়নি। গত মাসের শেষ দিকে যুক্তরাজ্যের মেফেয়ারে একটি বাড়ি ভাড়া করেন পুনাওয়ালা। বাড়ির ভাড়া নির্ধারণ হয়েছে সপ্তাহে ৫০ হাজার পাউন্ড (সপ্তাহে ৫১ লাখ রুপি)

এছাড়া তিনি চলাচল করেন ব্যক্তিগত জেট উড়োজাহাজ হেলিকপ্টারে। পাবলো পিকাসো, সালভাদোর দালি, রেমব্রান্ট পিটার পল রিউবেন্সের মতো বিখ্যাত চিত্রকরদের মূল্যবান চিত্রকর্ম সংগ্রহে রেখেছেন তিনি। এছাড়া তার মালিকানায় ফেরারি, বেন্টলি, রোলস রয়েস মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের ৩৫টি দুর্লভ মহামূল্যবান বিলাসবহুল গাড়িও রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন