মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে?

বণিক বার্তা ডেস্ক

অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। সার্বিক পরিস্থিতিও সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল। কারণে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে সময় লাগেনি মিয়ানমারবাসীর। প্রতিবাদে দ্রুতই রাস্তায় নেমে আসে তারা। অন্যদিকে ক্ষমতার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয় তাতমাদোও (মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েই বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। ফলে প্রতিদিনই প্রাণ ঝরছে মিয়ানমারের রাজপথে।

তাতমাদো মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে গত ফেব্রুয়ারি। এর পর থেকে পর্যন্ত মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫৫০ জনের। এর পরও বিক্ষোভকারীদের দমন করতে পারছে না তাতমাদো। শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন এগোচ্ছে মারাত্মক এক সংঘাতের দিকে। দেশটির বিভিন্ন আঞ্চলিক জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো এরই মধ্যে বিক্ষোভকারীদের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। নিজ নিজ এলাকায় পুলিশ সেনাচৌকিগুলোয় আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে তারা। অবস্থায় আন্তর্জাতিক মহলের আশঙ্কা, শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত রূপ নিতে পারে ভয়াবহ সর্বাত্মক এক গৃহযুদ্ধে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্নভাবে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও।

মিয়ানমার স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালে। এর পরের ৭৩ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই দেশটি ছিল সামরিক শাসনে। সর্বশেষ ২০১১ সালে দেশটির গণতান্ত্রিক রূপান্তর শুরু হয়। রূপান্তর ছিল আংশিক সেনানিয়ন্ত্রিত। তার পরও রূপান্তর প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ছিল দেশটির গণতন্ত্রকামী জনগণ। কিন্তু তাতমাদো আবার ক্ষমতা দখল করে নেয়ায় তাদের সে আশা রূপ নিয়েছে হতাশায়। ফলে গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে মরিয়া অবস্থান নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। নিরাপত্তা বাহিনী যতটা খড়্গহস্ত হয়ে উঠছে, ততটাই কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে তারা।

মুহূর্তে বিক্ষোভকারীরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এজন্য তারা দেশটির সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের কাজে যোগ না দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছে। বিশেষ করে সরকার প্রশাসনের সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি অচল করে দিতে চাইছে বিক্ষোভকারীরা।

অন্যদিকে মিয়ানমারের নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের অনেকেই এখন পলাতক। অজ্ঞাতবাস থেকেই জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন তারা। তাদের ভাষ্যমতে, সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিরাও সরকারের নীতিনির্ধারক ভূমিকায় থাকবে। নিয়ে অনলাইন সংলাপেরও আয়োজন করা হচ্ছে নিয়মিত। এসব সংলাপের মূল বিষয়বস্তু সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

মিয়ানমারের সর্বশেষ নির্বাচনে নির্বাচিত এক জনপ্রতিনিধির বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সামরিক জান্তাকে উত্খাতের পর কার্যকরের জন্য এরই মধ্যে একটি খসড়া ফেডারেল সংবিধান তৈরি হয়েছে। জাতিগত সংখ্যালঘু এবং বেসামরিক বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে খসড়া তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে তাতমাদোকে প্রতিস্থাপনের জন্য একটি ফেডারেল সেনাবাহিনী গঠনেরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

. সাসা নামে ওই জনপ্রতিনিধি রয়টার্সকে বলেছেন, যদি আন্তর্জাতিক মহল পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অবশ্যই এর পরিণাম হবে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধ। সেক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোয় আমাদের জন্য আরো রক্তাক্ত দিন, সপ্তাহ এমনকি মাসও অপেক্ষা করছে। একটি ফেডারেল সেনাবাহিনী গঠন করা এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে এবং এর মধ্য দিয়েই আমরা গণতন্ত্র স্বাধীনতা অর্জন করব।

জনপ্রতিনিধিদের ঘোষণায় সাড়া মিলেছে ব্যাপক। এরই মধ্যে ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ মিয়ানমারের বৃহৎ শহরগুলোর রাস্তায় প্রতিদিনই বিক্ষোভকারীরা সামরিক বাহিনীর তৈরি বর্তমান সংবিধানকে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিচ্ছে। মিছিল বের হচ্ছে ফেডারেল সেনাবাহিনীর সমর্থনেও। এর মধ্যে কোনো কোনোটি আবার সশস্ত্র। এয়ারগানসহ হালকা অস্ত্র নিয়ে এসব মিছিলে যোগ দিচ্ছে বিক্ষোভকারীরা।

ঘোষণায় সমর্থন জানিয়েছে জাতিগত সংখ্যালঘুদের সশস্ত্র দলগুলোও। এরই মধ্যে এসব দলের কোনো কোনোটি নিজ নিজ এলাকায় বিক্ষোভকারীদের সুরক্ষা দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর আগে নব্বইয়ের দশকের দিকেও এমন একটি দাবি উঠেছিল। তবে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে লক্ষ্যগত ভিন্নতার কারণে তা সফল হয়নি। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। অন্যদিকে তাতমাদোও স্বাভাবিকভাবেই ফেডারেল সেনাবাহিনীর ঘোষণাকে হুমকি হিসেবেই নেবে। এর কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবেন মিয়ানমারের জেনারেলরা। পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, দেশটিতে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।

মিয়ানমারে বর্তমানে সক্রিয় জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠনের সংখ্যা ২৫টিরও বেশি। এর মধ্যে কয়েকটি আবার জোটবদ্ধভাবেও লড়াই করছে। সম্প্রতি নেপিদোর সামরিক সরকার এসব জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক মিলিশিয়া সংগঠনের সঙ্গে এক মাসের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে সামরিক জান্তা বলেছে, সরকারের নিরাপত্তা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী কার্যক্রম ঘোষণার আওতার বাইরে থাকবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভাষ্যমতে, নেপিদোর ঘোষণায় স্পষ্টতই বিক্ষোভকারীদের প্রতি আরো খড়্গহস্ত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসও এক্ষেত্রে কাজ করতে পারে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।

ঘোষণার আগে কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে তাতমাদোর জোর সংঘর্ষ চলছিল। বিশেষ করে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এবং কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা জোরদার করেছে। অন্যদিকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগে তাতমাদোও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এসব সংগঠনের অবস্থান লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণসহ সামরিক অভিযান চালাচ্ছিল।

রাখাইনের আরাকান আর্মিসহ আরো তিনটি সংগঠনও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেয়ার ঘোষণা জানিয়েছে। মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিকে তারা বর্ণনা করছে বসন্ত বিপ্লব হিসেবে।

এসব সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই নিজ নিজ প্রদেশ এলাকায় স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সশস্ত্র সংঘাতের পথেও যেতে হয়েছে। এমনকি শান্তি বা যুদ্ধবিরতির সময়ও সেনানিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংগঠনগুলোর নানা বিবাদ লেগেই ছিল।

মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কাজটিও বেশ মুশকিল হবে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের। এমনকি দলগুলোর নেতারাও বলছেন, বিষয়টি বেশ কঠিন। কারেননি ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টির (কেএনপিপি) ভাইস চেয়ারম্যান খু রেহ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্রোহী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া নিয়ে ইতিবাচকভাবেই আলোচনা এগোচ্ছে। তবে দলগুলোর কোনো কোনোটির মধ্যে বিরোধও প্রায় ৭০ বছরের পুরনো।

তবে দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার জায়গা একটিই। দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে তাদের। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে দেশটির জাতিগত সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে বলে প্রত্যাশা তাদের সবারই।

অন্যদিকে সামরিক জান্তার প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে দেয়া এক বক্তব্যে বলেন, অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া জাতিগত সশস্ত্র দলগুলো এখন অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এবং সামরিক সরকারের আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষগুলোর সুরে নাচছে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন