সিটি করপোরেশন

গৃহকরের সামঞ্জস্য বিধানে নতুন আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন

ড. মইনুল ইসলাম

মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সিটি করপোরেশনের ধার্য বর্ধিত কর প্রদানের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, ‘সেবা চাইলে কর দিতেই হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন গৃহকর বাড়ায়নি, শুধু বিভিন্ন এজেন্সির দেয় করহার বাড়িয়েছে।হয়তো অদূর ভবিষ্যতে গৃহকরের হারও বাড়াতে হবে কিন্তু তার আগে তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ভূতপূর্ব মেয়রের সময় যেভাবে গৃহকর বাড়ানো হয়েছিল, তা একটি ভুল অধ্যাদেশের ভিত্তিতে করতে গিয়ে ওই সময় ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল। অতএব, ব্যাপারে কিছু করতে হলে প্রথমে সব সিটি করপোরেশনের গৃহকরের সামঞ্জস্য বিধানকল্পে নতুন আইন প্রণয়ন প্রয়োজন হবে। বক্ষ্যমাণ কলামে বিষয়টি বোঝানোর প্রয়াস নিয়েছি।

১৩ অক্টোবর ২০১৭দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার শিরোনাম হিসেবে যে চাঞ্চল্যকর খবরটি প্রকাশ হয়েছিল তা হলো, দেশের ১১টি সিটি করপোরেশনে মোট ছয় ধরনের গৃহকরের হার বলবৎ রয়েছে, যেখানে ঢাকা উত্তর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বার্ষিক সর্বনিম্ন ১২ শতাংশ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনেও ১২ শতাংশ, খুলনা সিটি করপোরেশনে ১৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ১৭ শতাংশ, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ১৭ শতাংশ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ১৯ শতাংশ, সিলেট সিটি করপোরেশনে ২০ শতাংশ, রংপুর সিটি করপোরেশনে ২০ শতাংশ এবং রাজশাহী বরিশাল সিটি করপোরেশনে ২৭ শতাংশ হারে গৃহকর আদায় করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এই ছয় রকমের গৃহকরের হারের ফলে রাজশাহী বরিশাল সিটি করপোরেশনের করদাতারা অন্য নয় নগরীর করদাতাদের চেয়ে বেশি পরিমাণ গৃহকর দিচ্ছেন বলে ধারণা করলে সেটা সঠিক হবে না। এমনকি চট্টগ্রামের করদাতারা ঢাকার করদাতাদের চেয়ে বেশি গৃহকর দিচ্ছেন কিনা, তা- সঠিকভাবে বলা যাবে না। কারণ এই ১১টি সিটি করপোরেশনে বাড়ির ভ্যালুয়েশনে কোনো অভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। ফলে রাজশাহী বা বরিশালে বাড়ির ভ্যালুয়েশন কম হলে ওই ভ্যালুয়েশনের ২৭ শতাংশ গৃহকরের পরিমাণ ঢাকা বা চট্টগ্রামের চেয়ে কম হতে পারে। তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে বাংলাদেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের গৃহকর নির্ধারণ আদায়ের পদ্ধতিগুলোয় কোনো রকম সামঞ্জস্য বিধান করা হয়নি এবং ব্যাপারে নৈরাজ্য বিরাজ করছে। অতএব, অবিলম্বে দেশের সব সিটি করপোরেশনের গৃহকর নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে ইউনিফর্ম পদ্ধতিতে নিয়ে আসার জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন (বা কমিটি) গঠন করে কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক অবিলম্বে সংসদে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ এখন ১৯৮৬ সালেরদ্য সিটি করপোরেশন ট্যাক্সেশন রুলসঅনুসরণে ১১টি সিটি করপোরেশনের যেখানেই গৃহকর নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হবে সেখানেই করদাতাদের তোপের মুখে পড়তে হবে কর্তৃপক্ষকে।

আরো তাত্পর্যপূর্ণ হলো, এই ১১টি সিটি করপোরেশনের কোনোটিতেই গৃহকরের হার নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে বাড়ি ভাড়ার আয়কে ব্যবহার করা হয় না। অথচ ১৯৮৬ সালের দ্য সিটি করপোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছিল দেশের তদানীন্তন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের জন্য। অধ্যাদেশ জারির ৩৫ বছর পার হয়ে গেলেও দেশের রাজধানী ঢাকাসহ কোনো নগরেই যে বাড়ি ভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণের ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয়নি, খবরটা কি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জানা নেই? এখন প্রকাশিত খবরগুলোয় দেখা যাচ্ছে, খোদ ঢাকা সিটি করপোরেশনে বাড়ির মেঝের আয়তন বর্গফুটের ভিত্তিতে হিসাব করে প্রতি বর্গফুট টাকা থেকে শুরু করে ১৬ টাকা ধরে সম্পত্তির ভ্যালুয়েশন নির্ধারণ করে ওই ভ্যালুয়েশনের ওপর ১২ শতাংশ হারে ততদিন পর্যন্ত গৃহকর নির্ধারণের নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। ১৯৮৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মোট চারজন মেয়র দায়িত্ব পালন করেছেন: মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, মীর নাসিরুদ্দিন, মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং মনজুর আলম। তাদের মেয়াদকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মোট তিনবার গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে, প্রতিবারই বাড়ির মেঝের আয়তন বর্গফুটের ভিত্তিতে ভ্যালুয়েশন করে গৃহকর বর্ধিত করা হয়েছে। প্রতিবারই নবনির্ধারিত গৃহকর পুরনো গৃহকরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি নির্ধারিত হলেও এগুলো নিয়ে এই ২৯ বছরে ব্যাপক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন পরিদৃষ্ট হয়নি, কারণ ওই বর্ধিত গৃহকরের পরিমাণ কোনোবারই করদাতাদের কাছে অস্বাভাবিক অসহনীয় বিবেচিত হয়নি। সাবেক মেয়র মনজুর আলমের সময় বাড়ির যে ভ্যালুয়েশন করা হয়েছে, তা- বাড়ির মেঝের আয়তনের ভিত্তিতে হিসাব করে ওই ভ্যালুয়েশনের ১৭ শতাংশ গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময়ের গৃহকরের চেয়ে মনজুর আলমের সময়ের গৃহকরের পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি হলেও তা করদাতাদের কাছে অসহনীয় মনে হয়নি।  ২০১৫ সালে মেয়র নির্বাচনের সময় , নাছির উদ্দীন নির্বাচনী ওয়াদা করেছিলেন যে তিনি তার মেয়াদকালে গৃহকর বাড়াবেন না। কিন্তু ২০১৬ সালে হঠাৎ তিনি ১৯৮৬ সালের ওই অধ্যাদেশের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে প্রথম সিটি করপোরেশন হিসেবে বাড়ি ভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন শুরু করে দেন। ওই সময় থেকে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়ি ভাড়ার জরিপ চালাতে গিয়ে অসংখ্য জোরজবরদস্তির ঘটনা ঘটিয়েছেন, ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে মনগড়া ভ্যালুয়েশন নির্ধারণ করেছেন, কাউকে অন্যায় সুবিধা দিয়েছেন, কাউকে আবার গলাকাটা ভাড়া দেখিয়ে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তারপর যখন নতুন হারে গৃহকর আদায়ের তোড়জোড় শুরু হয় তখন করদাতাদের ব্যাপক বিক্ষোভ আন্দোলন দেখা দেয়। প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীও ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

অথচ প্রাথমিক পর্যায়েই ২০১৬ সালের ২১ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার কলামে আমি তদানীন্তন মেয়র মহোদয়কে উদ্দেশ করে জানিয়েছিলাম যে বিশ্বের কোথাও হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ি ভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না। কারণ হোল্ডিং ট্যাক্স প্রকৃতপক্ষে যেহেতু সম্পত্তি কর বা প্রপার্টি ট্যাক্স, তাই সারা বিশ্বের সব সিটি করপোরেশনে প্রপার্টি ট্যাক্সের একই নিয়মে কর আদায় করা হয়। নিয়মটি হলো, সারা বিশ্বে সম্পত্তি কর বা প্রপার্টি ট্যাক্স আরোপ করা হয় সম্পত্তির ভ্যালুয়েশনের ভিত্তিতে। আর সম্পত্তির ভ্যালুয়েশন করা হয় ওই সম্পত্তির অবস্থান আয়তনের (বর্গফুট বা বর্গমিটার) ওপর ভিত্তি করে। নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় হোল্ডিং ট্যাক্সের হার প্রতি বর্গফুটে সবচেয়ে বেশি হবে, এর পরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় হোল্ডিং ট্যাক্সের হার প্রতি বর্গফুটে ক্রমেই কম নির্ধারণ করা হবে। এভাবে নগরীর কেন্দ্রে যে হারে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারিত হবে তা ক্রমে কমতে কমতে শহরতলিগুলোয় হোল্ডিং ট্যাক্সের হার সর্বনিম্নে চলে আসবে। বাড়ির গুণগত মানের ভিত্তিতেও ভ্যালুয়েশন বেড়ে যাবে বা কমে যাবে। যেমন মার্বেল পাথর বা টাইলসের মেঝে হলে প্রতি বর্গফুটে যে ভ্যালুয়েশন হবে, মোজাইক মেঝে হলে তার চেয়ে কম ভ্যালুয়েশন হবে। শুধু সিমেন্টের মেঝে হলে ভ্যালুয়েশন আরো কমে যাবে। টিনের ছাউনি পাকা ঘর হলে ভ্যালুয়েশন একবারেই কমে যাবে। বেড়ার ঘর হলে হয়তো কোনো গৃহকরই ধার্য হবে না। আমার ওই কলামেই আমি তাকে আহ্বান জানিয়েছিলাম যে যেহেতু বাড়ি ভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে বিশ্বের কোনো দেশের কোনো সিটি করপোরেশনে প্রপার্টি ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয় না, তাই সম্পত্তির আয়তন অবস্থানের ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণের পদ্ধতি অব্যাহত রাখা হোক। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার কলামে আমি আবারো পুরো বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু কোনো সুবিবেচনার পরিবর্তে বরং পুরো বিষয়টি নিয়ে তাকে রাগান্বিত হয়ে টেলিভিশনে পাল্টা বক্তব্য দিতে দেখা গিয়েছিল। একবার তিনি বললেন, ‘এরা কেউ কোনো দিন কোনো ট্যাক্সই দেয়নি, তাই এরা পানি ঘোলা করছে।আরেকবার তিনি এক সমাবেশে বললেন, ‘গৃহকর নিয়ে এত হইচই করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আপিল করলে ওটা কমিয়ে দেয়া হবে।তার ধরনের আক্রমণাত্মক মানসিকতা এবং ঢালাও বাক্যবাণ মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। আর আপিল করে গৃহকর কমানোর কথা বলা মানে সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ-বাণিজ্যের মহাযজ্ঞকে উৎসাহিত করাএটা তার জানার কথা। বাড়ি ভাড়ার যে জরিপ চালানো হয়েছিল, ওই জরিপে প্রচণ্ড ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তিনি কোনোভাবেই সত্যটার মুখোমুখি হলেন না যে বাড়ি ভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণ করলেডবল ট্যাক্সেশন অব ইনকামহয়ে যাবে, যেটা বিশ্বের কোথাও করা হয় না। ব্যাপারটা নিয়ে জেদাজেদি করতে গিয়ে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছিল বলা চলে। ওই সময় আমি নিজের উদ্যোগে ভারতের কলকাতা নগরী থেকে ওখানকার গৃহকর নির্ধারণের পদ্ধতি সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করেছিলাম। কলকাতা সিটি করপোরেশনেও সম্পত্তির অবস্থান, বাড়ির মেঝের আয়তন, বাড়ির গুণগত মান ইত্যাদি বিবেচনা করে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়। ভারতের সব সিটি করপোরেশনে নাকি একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

মাননীয় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি, তিনি নিজের উদ্যোগে কলকাতা, দিল্লি মুম্বাইয়ের মতো সিটি করপোরেশনের গৃহকর পদ্ধতি সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। এরপর তার দায়িত্ব হবে চট্টগ্রাম নগরীর নির্বাচিত মেয়র হিসেবে জনগণের পক্ষ থেকে ১৯৮৬ সালের দ্য সিটি করপোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস সংশোধনের জন্য মন্ত্রণালয়কে যথাযথ আইন প্রণয়নের অনুরোধ জানানো। আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ছাড়া কোনো স্বৈরাচারী সরকারের একটি ভুল অধ্যাদেশের ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনগুলোর গৃহকর আদায়েরজবরদস্তিসমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আমাদের সংবিধানে ‘No taxation without representationনীতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের কোনো আমলা বা মন্ত্রী বাড়ি ভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণের যে ধারণা দিয়েছিলেন, সেটাকে অপরিবর্তনীয় বিবেচনা করা বর্তমান সরকারের জন্যও বড়সড় ভুল হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। ওখানকার সব সিটি করপোরেশনে যে নিয়মে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করা হয়, আমাদের দেশে সে নিয়ম অনুসরণ করলে অসুবিধা কোথায়? ১৯৮৬ সালের দ্য সিটি করপোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস যথাযথ সংশোধন করে একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।

 

. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন